Author: সংহতি ইস্কুল

  • পরীক্ষা, ই-মেইল ও ইত্যাদি

     

    দুটো ব্যাপারকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে ও হচ্ছে ক্রমাগত। প্রথমত, একটা গোটা দিনেরও কিছু কম সময়ের নোটিশে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নির্ধারণে গণভোটের বন্দোবস্ত,  যেটা নিছক প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। সময়টা আরো অনেকটা বেশি দিলে কিছু প্রয়োজনীয় মতামত হয়তো উঠে আসতে পারত। তারপরেও কথা হল, কার্যকরী  ই-মেইল মারফত মতামত জানাতে সক্ষম জনসাধারণের সংখ্যাও নিতান্ত কম এ রাজ্যে। অতএব সরকারের এই ব্যবস্থাপত্রটি হয় চূড়ান্ত অবিবেচনাপ্রসূত, আর নয় তো স্রেফ এক ধোকার টাটি। পরীক্ষা না নেবার সিদ্ধান্ত হয়তো আগেই গৃহীত ছিল। নইলে প্রায় দেড়টা মাস জুড়ে রমরম করে নজিরবিহীন ভোটরঙ্গ উদযাপিত হল  অথচ মার্চ-এপ্রিলে পরীক্ষা নেওয়া গেল না–এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ডের কোনো ব্যাখ্যাই মেলে না।  হাজার দেড়েক মন্ত্রী এমএলএর ভাতা মুলতবির চাইতে প্রায় ষোলো সতের লাখ ছাত্রের পরীক্ষা বন্ধের কাজটাই তুলনামূলক লঘু আর শস্তা মনে হল সব সরকারের?  কিন্তু তারপরেই এসে পড়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন আর সেটা আরও মৌলিক : এবারের মতো পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া কি উচিত হল? নাকি হানিকর হল ছাত্রসমাজের পক্ষে?

    এই দ্বিতীয় প্রেক্ষিতে স্পষ্টত দুভাগ বুদ্ধিজীবী বিদ্বৎসমাজ। প্রচলিত চিন্তার পক্ষের, সরাসরি দক্ষিণপন্থী এবং মূলস্রোতের বাম সমর্থকদের মতে পরীক্ষা বন্ধটা যেকোনো পরিস্থিতিতেই এক মহা দুর্যোগ। এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশের মানুষ খুব স্বাভাবিক কারণেই পাশ ফেল প্রথা বজায় রাখারও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পরীক্ষাব্যবস্থা তাঁদের কাছে এক অপরিহার্য শুচিতার প্রতীক। পরীক্ষার কলে পেষাই না হলে ছেলেমেয়েরা সঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না–এমনটাই এঁদের অভিমত। এঁদের সঙ্গে দ্বিমত হতে অসুবিধা হয় না।

    কিন্তু, আমাদের মতো যাঁরা জানেন যে পরীক্ষার সাথে মূল বিষয়শিক্ষা, জীবনের অর্জন বা সৃষ্টিশীলতার কোনো সরাসরি সম্বন্ধ নেই, তাঁদেরও সামান্য গলতি হয়ে যাচ্ছে বর্তমান পটভূমির তুল্যমূল্য বিচারে। সত্যিই তো এটা ঠিক যে পরীক্ষার জাঁতায় শুধু প্রাণশক্তিই নিংড়ে যায়, প্রকৃত শিক্ষার সুযোগ তাতে অতি সামান্যই। কিন্তু মুসকিল হল এই যে সে কথাটা আজ এই দুহাজার একুশের মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের চরম সময়টিতে খেয়াল পড়লে চলবে কী করে? সেই ছাত্রছাত্রীরা কি পরীক্ষামুক্ত নির্ভেজাল সেই শিক্ষার জন্য প্রস্তুত? আমরা কি পিছনের কয় বছর ধরে প্রস্তুত করে তুলতে পেরেছি তাদের? চেষ্টা করেছি? তারা তো গতানুগতিক পথেই জেনেবুঝে এসেছে এতদিন। আজ হঠাৎ তাদের সামনে থেকে পরীক্ষা নামক এই তথাকথিত গন্তব্যটি মুছে ফেললে কী করে চলবে? প্রথমত তো এতে তাদের মধ্যে একটা আকস্মিক উদ্দেশ্যহীনতা জন্মাতে পারে, সিঁড়ির শেষ ধাপের জন্য পা বাড়িয়েও সিঁড়ি না পেলে যেমন হয়। তার মানসিক প্রভাব যথেষ্ট। আর দ্বিতীয়ত, পরবর্তী শিক্ষাজগতে প্রবেশের যে কায়দা-কানুন, তাতে তো এই দুই পরীক্ষার ফলাফলের গুরুত্ব আছে। সেটাকে পাশ কাটিয়ে কীভাবে এই পদ্ধতির অংশীদারত্ব শুরু করা যাবে সেটা পরিস্কার নয়। যে কোনো কলেজে ভর্তির জন্য উচ্চমাধ্যমিকের প্রাপ্ত নম্বর দ্যাখা হয়। কোনো টেস্ট বা ওইজাতীয় পরীক্ষাও নেওয়া যায়নি। কলেজগুলো কী ভিত্তিতে ভর্তি নেবে তবে এখন? অনেকে নির্দিষ্ট বিষয়ে ভর্তির জন্য সেই বিষয়ের পরীক্ষা নেবার কথা বলছেন। কিন্তু সে পরীক্ষাও তো অফলাইন হবার সম্ভাবনা কম। তবে স্মার্ট ফোন/কম্প্যুটার/ইন্টারনেট বঞ্চিত বৃহত্তর ছাত্রসমাজ কীভাবে সেইসব পরীক্ষা দেবে? বিভিন্ন রাজ্য স্তরের পরীক্ষা দেবার জন্যেও দরকার হয় এই দুই পরীক্ষার মূল্যায়ন। তারই বা কী নিরসন?

    প্রশ্ন উঠছে যে প্রায় দুখানা শিক্ষাবর্ষ জুড়ে কোনো কার্যকরী ক্লাস না হওয়া শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হবে কীসের ভিত্তিতে? প্রথম কথা হল, ক্লাস না নেওয়াটাও কিন্তু সরকারি গাফিলতিরই প্রকাশ।   কীভাবে এই লকডাউন পরিস্থিতিতেও পাঠদান চলতে পারত সে বিষয়ে কোনো মতামত বিনিময়ের উদ্যোগ দেখা যায়নি সরকারি তরফে। সুতরাং, তাঁদের অপদার্থতার কুপ্রভাব অনায়াসেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ওপর পড়তে দেওয়া সঠিক হবে কি? মাধ্যমিক না হলে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষার্থীর পছন্দ বা দক্ষতার কোনো পরিচয় পাওয়া যাবে না। ফলত, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে হয়। আবার উচ্চমাধ্যমিকে বিভিন্ন বিষয়ের মূল্যায়নের অনুপস্থিতি কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে।

    অতএব, এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য এই যে পরীক্ষাব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা, পরীক্ষার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্কহীনতা–বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় আনা দরকার। এবং শিক্ষাব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজার সদিচ্ছা ও সেই বাবদে দাবি-দাওয়ার আন্দোলন অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু  হঠাৎ এক ২০২১ এর জুনে বসে এক বছরের পরীক্ষার্থীদের নমুনা হিসেবে নিয়ে সে ব্যাপারে কোনো আমূল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়াটা ভুলই হবে, অন্যায্য হবে।

    এবারে, যদি ধরে নিই এবছর মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া যেত এবং নিলে ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে কোনো না কোনো অর্থে ভালোই হত, তখন আমরা আলোচনার পরবর্তী অংশে গিয়ে ঢুকতে পারি। সেটা হল কীভাবে নেওয়া যেতে পারত এই দুই পরীক্ষা। প্রথমেই, কোনোরকম অনলাইন পরীক্ষা বা উত্তর লিখে আপলোড করা ইত্যাদি সবরকম সম্ভাবনার উত্তরেই একটা স্পষ্ট ‘না’ জানিয়ে রাখতে হয়। যে রাজ্যে ৭০% লোকের ভালো মোবাইল নেই, অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেটের সংযোগ নেই বা থাকলেও খুব দুর্বল, সেখানে এই পদ্ধতি যে সবচাইতে বড়  বৈষম্যের কারণ হবে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং, প্রথমেই নাকচ করে দেওয়া দরকার অনলাইন পরীক্ষা সংক্রান্ত  যেকোনো চিন্তাভাবনা। পরীক্ষা নেওয়া গেলে–যদি আদৌ নেওয়া যেত–তাকে হতে হত সম্পূর্ণ অফলাইন। সেক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের নিজের নিজের স্কুলে পরীক্ষা হবার যে প্রস্তাব উঠেছিল সেটিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। এবং মনে রাখা দরকার যে স্কুলগুলোতে গত প্রায় দেড়খানা বছর ধরে পড়াশুনা কিছুই হয়নি বলা চলে। অতএব পরীক্ষা হলে তার প্রশ্নের পূর্ণ মান হওয়া উচিত ছিল অন্তত অর্ধেক (অর্থাৎ ৯০ এর অর্ধেক বা ৪৫), সমস্ত প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল অব্জেক্টিভ ধরনের, এবং পুরো বই থেকে পরীক্ষা না নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু অধ্যায় আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল যেখান থেকে প্রশ্ন হবে। এবং এই গোটা কাজটাই সম্পন্ন হওয়া দরকার ছিল পরীক্ষার দিন ঘোষণার সময়েই, যে সময়টা আবার বাছা উচিত ছিল পরীক্ষার সময় থেকে অন্তত মাস দুই আগের কোনো দিনে। এই সঙ্গে আরেকটা কাজও করে দেখা যেত বলে মনে হয়।  নেট সেট-এর মতো জাতীয় বা রাজ্য স্তরের পরীক্ষাগুলোর অনুসরণে বিভিন্ন বিষয়ের একসঙ্গে প্রশ্নপত্র করার ব্যবস্থা করতে পারলে পরীক্ষার দিন, প্রশ্ন ছাপানোর হ্যাপা সবেতেই খানিক কম করা যেতে পারত। অর্থাৎ, ধরা যাক একদিনের প্রশ্নে(মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে) বাংলা-ইংরাজি-ইতিহাস-ভূগোল বিষয়সংক্রান্ত প্রশ্ন থাকল: সবই অব্জেক্টিভ। আবার দ্বিতীয় দিন অঙ্ক-ভৌত বিজ্ঞান-জীবন বিজ্ঞানের প্রশ্ন হল এক প্রশ্নপত্রে। এতে করে দুদিনের মধ্যে গোটা পরীক্ষা প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত করে ফেলা যেত। পরীক্ষা গ্রহণের একাধিক স্লট করার ব্যবস্থাও অনেক ছাত্রছাত্রীর একজায়গায় সম্ভাব্য সমাগম কিছুটা কমিয়ে ভিড় থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা কম করত।

    কিন্তু এসবকিছুই বিভিন্ন মতামত আকারে উঠে আসা সম্ভব ছিল বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের বা এমনকি জনসাধারণের থেকেও, যদি সরকার সত্যিকারের সদিচ্ছা নিয়ে মতামত গ্রহণের পদ্ধতিটা চালাতে চাইতেন। তার জন্য মতামত নেবার পরিসর ও সময় দুটোই অনেকটা বাড়াতে হত অবশ্যই। বাস্তবত তাঁরা তা চাননি। আর আমরাও পরীক্ষা হলে ভালো নাকি নাহলে খারাপ–এই ব্যাসকূট তর্কে মজে এই মুহূর্তের সংকট মোচনের মতো কোনো আপাত তাৎক্ষণিক সমাধানসূত্র বার করার দিকে নজর দিচ্ছি না। যদিও তাতেও আর কিছু লাভ-লোকসান বৃদ্ধি নেই। সিদ্ধান্ত তো নেওয়াই হয়ে গিয়েছে।

    শেষ করার আগে এবার বক্তব্যের সবচেয়ে ছোটো কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশের অবতারণা করতে হবে। এই মুহূর্তে সবটুকু মনোযোগই নিবিষ্ট হচ্ছে পরীক্ষা হওয়া না হওয়ার প্রতি। কিন্তু শিক্ষা? পাঠদান? সবার আগে তো তারই জায়গা হবার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে কি? মাসের পর মাস সরকারি স্কুলগুলো বন্ধ এবং অনলাইন ক্লাস বলতে যা হচ্ছে এবং যে নগন্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রী তাতে অংশ নিতে পারছে তাতে শিক্ষা এক ইঞ্চিও এগোয় না এ একেবারে নিশ্চিত। পুনরাবৃত্তি হলেও বলতেই হচ্ছে সরকারি স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, জোরদার ইন্টারনেট কানেকশন, এবং আনলিমিটেড ডেটা কভারেজের সুযোগবঞ্চিত। ফলে কোনোভাবেই (ট্যাব কিনবার টাকা দিলেও) অনলাইন শিক্ষাদানে আমাদের রাজ্যের (বা দেশের) মূল ধারার শিক্ষার্থীদের অংশীদার করা অসম্ভব। তাহলে কি কিছুই করা যেত না ( বা যায় না এখনো?)? এলাকাভিত্তিক স্কুল ও তার শিক্ষকদের বাড়ির ঠিকানা সরকারের ঘরে মজুত আছে। ফলে যে শিক্ষক যে অঞ্চলে থাকেন তাঁকে সেই অঞ্চলের স্কুলের শিক্ষার্থীদের তাঁর  নিজের বিষয় পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারত। তার সাথেই টেলিভিশনে, এমনকি স্থানীয় কেবল চ্যানেলে স্থানীয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহায়তায় সম্প্রচারের মাধ্যমে মোটামুটি নিয়মিত পাঠদান পদ্ধতি চালু করা যেত। ইন্টারনেট না থাকলেও এলাকায় ক্লাব ইত্যাদিতে একটা টেলিভিশন প্রায় বেশিরভাগ জায়গাতেই পৌঁছে গেছে এখন। এই উপায় এখনো কেন যথাযথ কাজে লাগানো হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার। এমন আরো অনেক উপায় নিশ্চই আছে। সেগুলো খুঁজে বের করে বাস্তবায়িত করার সদিচ্ছার প্রয়োজন।

    সবশেষে আবারও বলি, পরীক্ষাব্যবস্থা বা আরো বড় করে বললে আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই পচন-ধরা, ত্রুটিপূর্ণ, প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্করহিত। এ বিষয়ে কোনো সংশয়ের জায়গাই নেই। কিন্তু সে বাবদে কোনো অর্থপূর্ণ দাবি-দাওয়া, আলোড়ন, আন্দোলন ইত্যাদি ছাড়াই হঠাৎ করে আজ করোনার প্রাদুর্ভাবকে উপলক্ষ্য করে দুটো তথাকথিত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্ত সেবছরের অপেক্ষমান ছাত্রছাত্রীদের ওপর কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না বলেই আমার মনে হয়।  কারণ, তার জন্য পরীক্ষাদুটোর পরবর্তী যে শিক্ষাজীবন, সেখানে পরিকল্পিত কিছু বন্দোবস্ত থাকা জরুরী ছিল। সে ব্যবস্থা ব্যতিরেকে ছাত্রছাত্রীরা–অন্তত যারা এর পরেও পড়তে চাইবে বা পারবে–তারা সে পথে এগোবে কী উপায়ে? আর যারা আর এগোবেও না, তাদের কাছেও এই পরীক্ষাগুলোর ফলাফল–তা সে যেমনই হোক–সম্পূর্ণ মানেহীন হবে না। হবে যে না, সেটা এই পরীক্ষাব্যবস্থার সাফল্য নয়, আমাদের এতদিনকার অভ্যস্ততার পরিণতি।কাজেই সেটা অন্তঃসারে অশুভ হলেও এই মুহূর্তে রাবার দিয়ে মুছে ফেলার মতো করে নাকচ করা যাবে না তাকে।  এখনকার মতো এ সংকট থেকে মুক্তির উপায় দরকার ছিল। তারপর সবাই মিলেই নামা যেত (বা এখনো যায়) গতানুগতিক পরীক্ষা (ও শিক্ষা) ব্যবস্থাবিরোধী আন্দোলনে। সে পথ থেকে সরে আসার প্রশ্নই ওঠে না।

    সিদ্ধার্থ বসু

    ১১ জুন ২০২১

    Original Source: https://edeshaamar.com/exam-email-etc/

     

  • এ যে কত বড় ক্ষতি.. শুধু পাঠ্য বিষয় না-শেখা নয়, মানুষ হওয়ার পথও আটকে যাচ্ছে

     

    “ওরা ভাল নেই।” গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যত বার প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তত বারই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাটা শুনতে হয়েছে। এক জন-দু’জন নয়, অনেকের কাছ থেকে। কাজের সূত্রে বহু প্রাথমিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়। ‘ওরা’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু। মাস্টারমশাইদের কথার সারসংক্ষেপ: স্কুল বন্ধ বলেই ওরা ভাল নেই। বিক্ষিপ্ত ভাবে নানা জনে নানা চেষ্টা করছেন, যাতে স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় লেখাপড়ার সঙ্গে বাচ্চাদের সংযোগটা বজায় রাখা যায়। খবর আসে, পাঠ দানের ছোট ছোট ভিডিয়ো, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সাহায্যে যোগাযোগ, ফোনে কথা, মা-বাবাদের পাঠ্য বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া, বাড়িতে কাজ করার জন্য ওয়ার্কশিট বানিয়ে পাঠানো ইত্যাদি নানা পদ্ধতিতে শিশুপাঠ জারি রাখার। “যত যা-ই করুন, এগুলো সিন্ধুতে বিন্দু। ক’জনের স্মার্টফোন আছে? ক’জনই বা ইন্টারনেটের সুবিধা পায়?” এখানে শিক্ষকেরা যে প্রশ্ন তুলছেন, সেটাকেই প্রমাণ করছে সম্প্রতি ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা— সারা পৃথিবীর অন্তত ৩০ শতাংশ বাচ্চার কাছে ফোন বা ইন্টারনেটের সুবিধা নেই। ভারতে এই অনুপাতটা অনেক বেশি হবে। তার উপর সমীক্ষা বলছে, বঞ্চিতদের তিন-চতুর্থাংশই গ্রামাঞ্চলের এবং দরিদ্র পরিবারের। প্রাথমিক শিক্ষকদের মঞ্চ ‘শিক্ষা আলোচনা’র সদস্য বন্ধুরা জানাচ্ছেন, শুধু গ্রামে নয়, শহরেও বহু শিশুর কাছে স্মার্টফোন জাতীয় সুবিধা স্বপ্নের ব্যাপার। ফলে একটা দুশ্চিন্তা এই যে, দীর্ঘ দিন স্কুলের সঙ্গে অ-সংযোগের কারণে বাচ্চাদের অনেকেই স্কুলছুট হয়ে যাবে। পৃথিবীর অভিজ্ঞতাও তাই বলে। ইবোলা মহামারির কারণে সাত মাস স্কুল বন্ধ ছিল লাইবেরিয়ায়, স্কুলছুট হয়েছিল ২৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আমাদের দেশে অনুপাতটা অনেক বেশি হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা মনে করছে, ২০০০ সালের পর বিশ্বে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কমে যাওয়া শিশুশ্রমের হার (৯৪ শতাংশ) আবার উল্টো পথ নিতে পারে। অচিরেই বিশ্বে এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে বহু শিশুকে সস্তা মজুরের বাজারে দেখতে পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে দুঃস্বপ্নের মতো নেমে আসছে আর এক সঙ্কট। একটা গোটা প্রজন্ম পাঠের অন্তর্গত বিষয়ের প্রায় কিছুই শিখতে পারবে না। আজ়িম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির করা একটি গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে যথাক্রমে ৯০ শতাংশ ও ৮২ শতাংশ শিশু ভাষা ও গণিত বিষয়ক সামর্থ্যের দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। “এমনিতেই এক-দু’সপ্তাহ কামাই হয়ে গেলে বাচ্চারা অনেক কিছু ভুলে যায়, তাদের নতুন করে শেখাতে হয়। এখানে তো মাসের পর মাস পড়ার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। কী হবে বলুন তো? আবার অনেকে শিশু শ্রেণির বা প্রথম শ্রেণির ক্লাসে আসতেই পারেনি। তাদের অবস্থা ভাবুন।”— বলছিলেন এক শিক্ষক।

    “গোটা প্রজন্মটাই অন্ধকারে চলে গেল। এ যে কত বড় ক্ষতি, অনুমান করতেও ভয় লাগে।” তিনি যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছেন: “শুধু গণিত, বাংলা, ইংরেজি, পরিবেশের মতো পাঠ্য বিষয়ের ক্ষতি হলে একটা কথা ছিল। বাচ্চাদের মানুষ হয়ে ওঠার পথটাই আটকে গেল। তাদের মানসিক বিকাশের অনেকটাই ঘটে ইস্কুলে। এখন ওরা নিঃসঙ্গ। একেবারে একা।” শিক্ষাবিজ্ঞান আমাদের জানায় যে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গত সামর্থ্য যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি শিশুদের সামাজিক-আবেগগত শিক্ষা (সোশিয়ো-ইমোশনাল লার্নিং)। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়া, খেলতে না পারা, বাইরে বেরোতে না পারা, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ না থাকা ইত্যাদি কারণে শিশুরা বিষণ্ণতার শিকার হচ্ছে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব পরিবারেই। বিত্তশালী বাড়ির বাচ্চারা হয়তো প্রযুক্তি, মা-বাবা, প্রাইভেট টিউশন প্রভৃতির সাহায্যে পাঠ্য বিষয় শিখে উঠতে পারছে, এবং প্রতিযোগিতার বাজারে তাদের দরিদ্র সহপাঠীদের থেকে হাজার হাজার মাইল এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়ায় বঞ্চিত হচ্ছে তারাও। তাদের মধ্যেও বেড়ে উঠছে ফোন বা ইন্টারনেটকে সঙ্গী করে, ঘরের মধ্যেই এক বিচ্ছিন্ন বিশ্বে নিজেকে বন্দি করে রাখার ঝোঁক। দরিদ্রের সমস্যা ঘোরতর। এক দিকে ক্ষুধা, অনাহার, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যের বিপদ, অন্য দিকে, তাদের মনের উপর নিরন্তর চাপ। সারা ক্ষণ রোগ নিয়ে কথা, মা-বাবার অনিশ্চিত রোজগার নিয়ে কথা, মৃত্যু নিয়ে কথা। তাদের জীবন এমনিতেই আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় ভরা, স্কুল তাদের সেই সব সঙ্কট থেকে খানিক মুক্তি দিত। “ইস্কুল বন্ধ হয়ে তাদের জীবনটাকেই ছারখার করে দিল। তাদের কত জনের বুদ্ধি স্বাভাবিক পথে এগোবে, বলা কঠিন। কেউ মুষড়ে পড়ছে, কেউ আরও একাকিত্বে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা অপরাধের দিকে ঝুঁকছে”, বলছিলেন এক শিক্ষিকা। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি: “তাদের মধ্যে যারা ইস্কুলে ফিরতে পারবে, তাদের কত জনকে আমরা একটা সুস্থ জীবনের পথ দেখাতে পারব, আমার জানা নেই।”

    এক কথায়, দেশের কয়েক কোটি শিশুর জীবন থেকে তাদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হল। বন্ধু, শিক্ষক, স্কুল, কলতলা, খেলার মাঠ, আকাশের রং, গাছের পাতা, পাখির ডাক, আইসক্রিম বিক্রেতার ঘণ্টি, কাগজের নৌকা, মাটির গন্ধ— সব কেড়ে নেওয়া হল। কেড়ে নেওয়া হল, কারণ সেটাই সবচেয়ে সহজ, তার জোরালো ঐতিহ্য আছে। আমরা এমন এক দেশের বাসিন্দা, যেখানে শিশুদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে জেনেও ভোট, পুলিশ ক্যাম্প, পার্টির মিটিংয়ের মতো নানা কাজে সর্বাগ্রে স্কুলটার দখল নেওয়া হয়। সেই ঐতিহ্য মেনেই, কোভিডের ত্রাহি রব শুরু হওয়ামাত্র সরকার প্রথমেই যেটা করল, তা হল স্কুল বন্ধ করে দেওয়া। শিশুদের লেখাপড়ার কী হবে, তাদের জীবনের কী হবে, এ সব ভাবনা সরকারের নীতিতে জায়গা পায়নি। আবার নাগরিক সমাজও বোধ হয় অতিমারির আতঙ্কে এতটাই বিহ্বল যে, দেশের শিশুদের কথা তার মাথায় আসেনি। তাই যদি বা কেউ প্রশ্নটা তোলার চেষ্টা করেছেন, তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগে প্রাণ বাঁচাতে হবে, তার পরে লেখাপড়া, ও সব পরে হবে।

    সামান্য তলিয়ে ভাবলে সত্যটা অন্য ভাবে ধরা দিত। লেখাপড়া ও শিশুদের জীবনের গড়নের কাজটা অতিমারি প্রতিরোধের বিরোধী নয়। এবং, মারিতে যে ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে— জীবনহানি, দুর্ভোগ, আয়ের ক্ষতি ইত্যাদি— তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হয়ে চলেছে মাসের পর মাস স্কুল বন্ধ থাকায়। শিশুরাই যদি ভাল না থাকে, দেশ কী করে ভাল থাকবে? বস্তুত, এই চিন্তা থেকেই বিশ্বের কিছু কিছু দেশে অতিমারির মধ্যে বাচ্চাদের লেখাপড়া ও গোটা জীবনকে অক্ষত রাখার জন্য নানা ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন, সুইডেন স্কুল খোলা রেখেছে, শিশুদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থেকেছে। ইউরোপের যে সব দেশ স্কুল বন্ধ রেখেছিল, তাদের মধ্যে অনেক দেশই আবার স্কুল খুলে দিয়েছে বা দিচ্ছে। কিছু দেশে স্কুল পুরো খোলা হয়নি, কিন্তু পাড়ায় গিয়ে ছোট ছোট দলে শিশুদের লেখাপড়া করানো হচ্ছে। বহু দেশে ইস্কুল বন্ধ থাকা অবস্থাতেও দৈনিক স্কুলের খাবার দেওয়া হয়েছে; আমাদের এখানে যে রকম মাসিক চাল, আলু ইত্যাদির প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমন নয়। খাবার দেওয়ার প্রক্রিয়ায় বাচ্চাদের সঙ্গে খানিকটা হলেও স্কুলের যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা হচ্ছে।

    আমরা কি পারতাম না? কিছু শিক্ষক তো ছোট ছোট আকারে বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবন ধরে রাখার কাজে নানা উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিশুদের বাড়ির কাছে কোনও ফাঁকা জায়গায় ছোট দলে ভাগ করে, অথবা বিভিন্ন বয়সের বা শ্রেণির শিশুদের জন্য পালা করে ক্লাস চালানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ রাজ্যেও কিছু কিছু জায়গায় শিক্ষকেরা স্থানীয় শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সাহায্যে এ রকম ক্লাস চালাচ্ছেন। আবার, কোথাও স্থানীয় নেতাদের অতি সতর্কতার দাপটে উদ্যোগ শুরু করেও থেমে যেতে হয়েছে। সরকার চাইলেই শিশুদের জীবন স্বাভাবিক রাখার জন্য এই সমস্ত শিক্ষক, সমাজের অন্যান্য মানুষ ও রোগ-বিশারদদের সঙ্গে পরামর্শ করে নানা ভাবে স্কুল খোলার ব্যবস্থা করতে পারত। সেটা শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন অবদান রাখতে পারত। রোগ-বিশারদ ও জনস্বাস্থ্যবিদদের মধ্যেও জোরালো আওয়াজ উঠছে স্কুল খোলার, যার উদাহরণ— দ্য গ্রেট ব্যারিংটন ডিক্লারেশন।

    সাবধানতা মেনেই স্কুল খোলা যায়। কিন্তু সাবধানতার নামে ছোটদের জীবনের গতিটাকে রুদ্ধ করে দেওয়া চলে না। তাদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার জন্য কথা বলতে হবে, কথা শুনতে হবে, চিন্তা করতে হবে এবং শিশুদের জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তাটা অনুভব করতে হবে। স্বীকার করতে হবে যে— ওরা ভাল নেই।

    কুমার রাণা
    ১১ জুন ২০২১ ০৪:৫৫