সল্টলেক ১২ নং ট্যাঙ্ক, জলসম্পদ ভবনের কাছে IEM Public স্কুলের পাশেই এই বস্তি।
সন্ধ্যা ছ’টা বাজতে যায়, এখনো স্কুল ঘরটা অন্ধকার; সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বাল্বটা জ্বলে ওঠার কথা, কিন্তু এখনো কারেন্ট আসেনি। আগাছার জঙ্গলের মাঝে দর্মার বেড়ার ঘরটায় কখন আলো জ্বলে উঠবে, সেই অপেক্ষায় সাত-আটজন কচিকাচারা বই-খাতা, ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে আছে, বাকিরা এখনো আসছে। কারেন্ট নেই, স্কুল ঘরের জন্য কাছেই রাস্তার একটা দোকান থেকে দৈনিক কুড়ি টাকা হিসেবে একটা পয়েন্টে বাল্ব জ্বালানোর জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছে। তাও সেটা অনিয়মিত, ঠিকঠাক সময় আলো জ্বলে না। প্লাস্টিকের ত্রিপলের ছোটো ছোটো ঘুপচি ঘর, তারই মাঝে এখানে ওখানে আঁকাবাঁকা অন্ধকার গলি। উঁচু বিল্ডিং, সরকারি আবাসন, পাবলিক স্কুল দিয়ে ঘেরা, মাঝখানে অন্ধকার ঝুপড়ি। বিদ্যুত নেই, পানীয় জল নেই, শৌচালয় নেই, নালা-নর্দমা নেই-অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কয়েক’শো মানুষের মাথা গোঁজার আশ্রয়। নাহ্, কোনো গ্রাম বা মফস্বলের ছবি নয়, এটা ঝাঁ- চকচকে উপনগরী সল্টলেকের ছবি, যার আরেক নাম বিধাননগর। বিলাসবহুল সাজানো গোছানো বিল্ডিং, কর্পোরেটদের দৈত্যাকার অফিসের বিল্ডিং, নামীদামি কোম্পানির রেস্টুরেন্ট, শপিং মলে ভরা টাকাওয়ালাদের সুখের শহর। যে শহরে ধনী লোকেদের ঐশ্বর্যপুরির আনাচে কানাচে অবহেলিত গরীব মানুষেরাও থাকেন। যাঁরা এই সল্টলেকেই রিক্সা চালান, হকারি করেন, জোগাড়ে কাজ করেন, রঙ মিস্ত্রির কাজ করেন, রাস্তা সাফাইয়ের কাজ করেন। যাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যত গরীব ঘরে জন্ম নেওয়া থেকেই যেন নিশ্চিত হয়ে গেছে। তারাও আগামী দিনে বাপ-মার মতো গরীব থাকবে, অবহেলিত থাকবে অধিকারহীন জীবনযাপন করবে-এটাই যেন ভবিতব্য।
একশো ঘর মানুষের বাস। 2017 সালের ফুটবল বিশ্বকাপের সময় সল্টলেকের সৌন্দর্য্য রক্ষার অজুহাতে প্রশাসন থেকে এই বস্তি উচ্ছেদ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বস্তিবাসীরা নিজেরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই, প্রতিবাদ করে, সেবারের উচ্ছেদকে রুখে দেয়।
আপাততঃ সপ্তাহে ৩ দিন এখানে পড়ানো হচ্ছে, ঐ ৩ দিন গড়ে ২৫-৩০ জন বাচ্চা আসে, সবাই নিয়মিত আসে না বা আসতে পারে না।
অনেকক্ষণ হলো স্কুল ঘরে আলো জ্বলছে না, বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যদিও একটা জেনারেটর কেনা হয়েছে, সেটাতে খরচাও হয় প্রচুর, মেশিন চালানোর লোকেরও অভাব। তবুও সবরকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। অন্ধকার গলি দিয়ে আরও কিছু বন্ধুদের আসতে দেখে ওদের কয়েকজন এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে- “বাড়ি চল, আজকে কেলাস হবে নারে”। ঠিক সেই সময়েই আলো জ্বলে ওঠে, সাথে সাথে কচিকাচাদের আনন্দ-চিৎকার- ‘হে-এ-এ কারেন্ট এসেছে, আলো জ্বলেছে, হে, হে, হে, হে!’ হুড়মুড় করে ঢুকে মেঝেতে পাতা মাদুরে, শতরঞ্চিতে যে যার মতো পছন্দের জায়গায় বসে পড়ে। কেউ খাতা বের করে আঁকা শুরু করে দেয়, কেউ খাতা এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘দাদা আমাকে গুণ আর ভাগ অঙ্ক দাও, করি’,কেউবা বাংলা বইটা বার করে বলে, ‘দাদা আমাকে তোত্তোচানের অ্যাডভেঞ্চার গল্পটা পড়িয়ে দাও।’ যাদের আবার পড়াশোনা করতে ভাল্লাগে না, তারা আব্দার জুড়ে দেয়,’দাদা আমরা আজকে আর পড়বো না, খেলবো। আমাদের একটা খেলা খেলাও দাদা।’ কেউবা আব্দার জুড়ে দেয় একটা গল্প শুনবো বলে। কখনো কখনো ওদের আব্দার মেনে কিছু ইনডোর গেম খেলানো হয়; কথা না শুনলে কখনওবা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, বই পড়ানো বা লেখানোতে মন দেওয়া হয়। বাচ্চারা এখানে আসে, লেখে, পড়ে, আঁকে, গল্প শোনে, গল্প বলে,গান গায়, খেলা করে- নিজেদের ইচ্ছে-খুশি মতো সময় কাটাতে পারে। ওদের ইচ্ছে ডানায় ভর করে যাতে আনন্দের সঙ্গে কিছু শিখতে পারে, জানতে পারে, আমরা সেই আকাশটাকে ওদের দেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের লক্ষ্য এবং চেষ্টা থাকে সবকিছুর মধ্যে দিয়ে বাচ্চারা যাতে কিছু না কিছু শিখতে পারে, নতুন কিছু জানতে পারে। মারধোর বা ধমক-চমকে নয়, আনন্দের সাথে, হাসি -খুশি মনে। খুব বড়ো বয়সের বা উঁচু ক্লাসের বাচ্চারা নয়, ক্লাস সিক্সের দু’একজন, ক্লাস ফাইভের দু’তিনজন, বাকিরা ক্লাস থ্রী, টু, ওয়ান, ইনফ্যান্ট মিলিয়ে প্রায় চল্লিশজন ছাত্রছাত্রী এখানে আসে।
প্রথাগত শিক্ষায় যে বাচ্চাটি যে ক্লাসে পড়ছে সেই পাঠক্রমের পড়াগুলোয় সাহায্য করার পাশাপাশি পিছিয়ে পড়া দিকগুলোর দিকেও আমরা নজর রাখি।
আলোর সমস্যা, মশার কামড়, অসহ্য গরম- এইসব সমস্যা তো আছেই। এখানে যাঁরা পড়াতে আসেন, তাদেরকে এই পরিবেশ-পরিস্থিতির মোকাবিলা করেই বাচ্চাদেরকে পড়াতে হয় এবং বাচ্চাদেরকেও পড়তে হয়।সব বাচ্চারা আসে না, মাঝে মাঝে ডেকেও আনতে হয়। অনেকে একটা দিন এসে আরেকটা দিন আসতে পারছে না, কারণ ফুটপাথে তাদের একটা দোকান আছে, মা সারাদিন সেই দোকানে থাকে, বাবা বাইরের কাজ থেকে ফিরে বিশ্রাম নেন বা অন্য কাজ করেন তাই তখন সেই ছাত্র বা ছাত্রীটিকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দোকানে বসতে হয়। এই বস্তির অনেকেরেই দেশের বাড়ি মাঝে মধ্যে যাওয়া আসা করেন, পেটের দায়ে, কাজের খোঁজে এই শহরে ঠাঁই নিলেও, আত্মীয়-পরিজনদের সাথে দেখা করতে বা চাষাবাদ করতেও গ্রামের বাড়িতে চলে যান অনেকে, তখন সেইসব ছাত্র-ছাত্রীদের চলমান পড়াশোনায় হঠাৎ করে ছেদ পড়ে যায়। এর ফলে যিনি শেখাচ্ছেন আর যে শিখছে- দুজনের মধ্যেই ফাঁক তৈরী হয়, অসুবিধার সৃষ্টি হয়।এমনিতে অন্যান্য অনেক বস্তির বাচ্চাদের মতোই এই ঝুপড়ি- বস্তির বাচ্চারাও পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে। বর্তমানে যে ক্লাসে পড়ছে, সেই ক্লাসের পড়া তো দূরের কথা, তার আগের ক্লাসের সিলেবাস সম্পর্কেই কোনও ধারণা নেই- এমন ছাত্র-ছাত্রী প্রচুর। গড়গড় করে বাংলা পড়তে পারে হাতে গোনা কয়েকজন, বানান করে, বর্ন চিনে চিনে পড়তে গিয়ে হোঁচট খায় অনেক বাচ্চারা। চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে অথচ ঠিকমতো গুণ বা ভাগ করার পদ্ধতি জানে না। ইংরেজী উচ্চারণে ভুল করে, শব্দ গঠন করতে পারে না- শেখাতে গিয়ে এমন হাজারো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।
তাই আমরা যারা এই স্কুলে পড়াই, যে বাচ্চাটি ঠিকমতো বর্নমালা চেনে না, তাকে সেটা চেনানো, সেগুলোকে লেখানো, অঙ্কের প্রাথমিক নিয়ম, পদ্ধতি, যোগ, গুণ, বিয়োগ, ভাগ- এইসব গুলো শিখিয়ে আগামীদিনের ভিতটাকে মজবুত করার চেষ্টা থাকে আমাদের।
নিজেদের অধিকারকে সুরক্ষিত করতে গেলে..
লড়াইটা অন্য কেউ এসে লড়ে দেবে না, শেষ পর্যন্ত লড়াইটা তাদেরকেই লড়ে যেতে হবে ।
আর তাই সেই ভাবনায় ভাবিত করতে তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার নৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়ে কীভাবে মানুষ হয়ে ওঠা যায় সেইধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টাও থাকে আমাদের। এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণী পাশ করে সার্টিফিকেট জোগাড় করা নয়, কেন কোনো কিছু শিখছে, জানছে, পড়ছে – সেগুলো তাদের জীবনে কী কাজে আসবে, সেই উদ্দেশ্য, লক্ষ্যের দিকেও খেয়াল রেখে তাদেরকে গড়ার প্রয়াস থাকে। পড়াশোনা সবাই করলেও অনেকের মানুষ হয়ে ওঠাটাই হয় না। পড়াশোনা করে সমাজে সে কী ভূমিকা পালন করবে সে সম্পর্কে আজকের ছাত্র-ছাত্রীরা অসচেতন, দিশাহীন। এই যে বস্তি অঞ্চলের বাচ্চারা, যারা নূন্যতম নাগরিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত, তাদের পরিবার, মা-বাবা – কেউই তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। এই সমাজে তাদের কোথায় কতটুকু অধিকার আছে, সংবিধানে, আইনে কী আছে তা তারা জানেনই না। তাদের এই অজ্ঞানতার সুযোগকে কাজে লাগিয়েই রাজ্য কিংবা আমাদের দেশের শাসকদল তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাদের বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে যা যা সামান্য সুযোগ সুবিধা এই বঞ্চিতদের কাছে আসে, সেটাকেই অনেক পেয়ে গেছি বলে মনে করেন এরা। বস্তি জীবনে এই মানুষগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম এভাবেই অবহেলিত থেকে যায়। তাই সাধারণ পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, আইনে কোথায় কী আছে তা জানা, সংবিধানে কোথায় কতটুকু তাদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে সেগুলোকে জানাবার চেষ্টা করি আমরা। যাতে আজকের যারা শিক্ষার্থী আগামীদিনে তারা নাগরিক হয়ে উঠে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। নিজেদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে নিজেরাই যাতে প্রতিবাদ জানাতে পারে, নিজেদের প্রয়োজন গুলো যাতে নিজেরাই আদায় করে নিতে পারে। আগামী দিনে এই বস্তিতে ‘বয়স্ক শিক্ষার’ ক্লাস শুরু করার পরিকল্পনাও আছে আমাদের। এরই মধ্যে এখানকার অনেক পুরুষ, মহিলারা এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন।