- কোরোনা ভাইরাস এখনো আমাদের দেশ তথা গোটা বিশ্বকে নানান ভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। যার মধ্যে সংখ্যালঘু গরীব সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত, ক্ষতিগ্রস্ত। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলি জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তায় চরম সংকটে ভুগছে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো আমফান এসে কোরোনা, লকডাউনের সাথে সুন্দরবনসহ প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলের মানুষদের জীবনকে আরও কষ্টকর করে তুলেছে। বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে, দেশের অর্থনীতিরও বেহাল অবস্থা। এমন একটা অস্থির পরিস্থিতিতে বাড়ির ছোটোরা যারা এখনো কাজের জগতে আসেনি, পড়াশোনা করছে, তাদের জীবনেও কোরোনা গভীর প্রভাব ফেলেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ। কবে খুলবে, আদৌ এ বছর খুলবে কিনা তাই নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে। এখোনো পর্যন্ত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ফলাফলই বেরোয়নি। কবে রেজাল্ট বেরোবে আর কবে নতুন ক্লাসে একাদশ শ্রেণীতে এইসব ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হবে ? রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকলেও অনেক ছাত্র-ছাত্রীই এরই মধ্যে বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে একাদশ শ্রেণীর পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে। অন্ততঃ ক্লাস ইলেভেনের বাংলা আর ইংলিশ কমন সাবজেক্ট দুটো। রেজাল্ট না বেরোনো পর্যন্ত তো আর এখনই কোনো বিভাগ বেছে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না; সায়েন্স, কমার্স নাকি আর্টস কে কোনটা নিয়ে উচ্চ শিক্ষার পড়াশোনায় ভবিষ্যতকে নিশ্চিত করবে তা এখনই নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।
একাদশ শ্রেণীর দু’তিনটে পরীক্ষা বাকি থাকলেও, তাদের আর পরীক্ষা দিতে হচ্ছে না। তারা পাশ করে দ্বাদশ শ্রেণীর সিলেবাস নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছে। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদেরও প্রায় বলে দেওয়া হয়েছে আর পরীক্ষা দিতে হবে না, সটান কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে পারবে। ঝুঁকিহীন ভাবে অর্ধেক পরীক্ষা দিয়ে, রেজাল্টের মাধ্যমে মান নির্ণয়, যোগ্যতা নির্বাচন ছাড়াই আরামসে এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে উত্তীর্ণ হতে পেরে ফাঁকিবাজ ছাত্রছাত্রীরা তো বেজায় খুশি! একজন একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী, যদিও এখন সে দ্বাদশ শ্রেণীর, তার কথায়- “এইভাবে যদি পরীক্ষা, রেজাল্ট ছাড়াই প্রতিটা ক্লাসে পাশ করে যেতাম, তালে হেব্বি হোতো!” রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকা একজন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বলছে, ” লকডাউনটা উঠে যায় যাক কিন্তু কোরোনা থাকুক, তালে আর স্কুলে টুলে যেতে হবে না। ভারী মজা!” আসলে ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থীদের এইধরনের চিন্তা ভাবনাটাই স্বাভাবিক। শিক্ষাটা যখন শুধুমাত্র জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার মতো হয় তখন সেখানে শেখার বা জানার আনন্দটাই হারিয়ে যায়। এমন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল যে শুধু কিছু তত্ত্ব এবং তথ্যকে মুখস্থ করে গিলে, সংখ্যার পিছনে ছুটে পরীক্ষার খাতায় বমি করে আসাটাই শিক্ষার মানদণ্ড বা ভবিতব্য হয়ে উঠেছে। এটাই যেন মনে হয় স্বাভাবিক। কোনো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে গভীরভাবে জানতে বা বুঝতে ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশই নিরুৎসাহিত বোধ করে। একজন আমিষ প্রিয়কে জোর করে নিরামিষ গেলানোর মতো শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমকে জাস্ট গিলিয়ে দেওয়া হয়। তাতে পুষ্টি তো দূরের কথা তাৎক্ষণিক তৃপ্তি বা আনন্দটুকুও মেলে না। এইভাবেই আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা অজ্ঞানতার অপুষ্টিতে ভোগে আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্যহীন ছুটে চলে। এরাই দেশের নাগরিক হয়, দেশের ভালো- মন্দ বিচার করে। তাই দেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসিত হলেও গণর অর্থাৎ জনগণের ভূমিকা থাকে জম্বি মানে জীবন্ত লাশের মতো। শিশুবেলা থেকে নাগরিক হয়ে ওঠা পর্যন্ত সে শুধুই কাগজই গিলেছে জ্ঞানকে আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি। তাই বেকারত্বের সাথে লড়াই করতে করতে যা হোক একটা কাজ জুটিয়ে, বিয়ে করে, সন্তানের জন্ম দিয়ে সংসারী হয়ে নিরাপদ জীবন কাটানোর পরিকল্পনা করে। দেশের জন্য ভাবতে তার বয়েই গেছে; কর্তব্য, দায়িত্ব ঐ ভোট মেশিনের বোতাম টেপাতে, উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় ‘মেরা ভারত মহান’ বলাতে, দেশের ভালো চেয়ে সমালোচনা করা মানুষ পেটাতে আর সরকারের দালাল চ্যানেল দেখে উত্তেজিত হয়ে যুদ্ধ হোক, যুদ্ধ চাই, বলাতেই সীমাবদ্ধ। না, বিষয়ের বাইরে চলে গিয়ে বেলাইন হয়ে যাচ্ছে লেখাটা। লাইনে ফিরে আসি।
সরকারি স্কুলগুলোতে বাস্তবসম্মত পঠনপাঠনের ব্যবস্থা নেই, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনুযায়ী যথেষ্ট শিক্ষক নেই, অধিকাংশ সরকারি স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাবরেটরি নেই, লাইব্রেরি নেই, খেলার মাঠ নেই। ভিডিও বা সিনেমার মতো ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে শেখার ব্যবস্থা নেই। বছরে একবার অন্তত শিক্ষামূলক ভ্রমণের ব্যবস্থা নেই। শুধু বই পড়ে আর শিক্ষক-শিক্ষিকার থেকে জেনে কতটুকু জানা বা শেখা যায়? মালভূমি, পাহাড়, ঝর্ণা, মরুভূমি নিজের চোখে না দেখে বইয়ের পাতায় অস্পষ্ট ছবি আর কল্পনা দিয়ে কতটা উপলব্ধি করা যাবে? সেটা ইতিহাস হোক বা বিজ্ঞান যে কোনো বিষয়কে শিক্ষার্থীদের কাছে বাস্তবসম্মত(practicaly) মনোগ্রাহী (interesting) করে না তুলতে পারলে তাদের কাছে পড়াশোনাটা নীরস, কাঠকাঠ মনে হবে। বাবা-মা পড়তে বলছে, তাই একরকম জোর করে পড়া, নিজেদের ইচ্ছা বা মনের জোরে পড়াশোনাটা করা সকলের হয় না। আর এখন কোরোনা আবহে স্কুল বন্ধ রেখে অনলাইন পঠন পাঠন চালু হলে এই পিছিয়ে পড়া, পড়াশোনায় অনুৎসাহীদের অবস্থা আরও বেহাল হবে। একজন থার্ড ইয়ারের কলেজ ছাত্রী জানালো, এই জুলাই মাসেই তার নাকি পরীক্ষা! কিন্তু সে চিন্তিত পরীক্ষাটা আদৌ হবে কি না সেই নিয়ে। সে সংশয় প্রকাশ করলো এই বলে,”এবারে অনলাইনে পড়াশোনা করাটাই বরাবরের জন্য চালু হয়ে যাবে মনে হচ্ছে! দেখি থার্ড ইয়ারটা হয়ে গেলেই বাঁচি। পরে যদি পড়াশোনা করতে হয় Distance- এ কোনো মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করবো।” উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জটিল সংকট ঘনিয়ে উঠেছে। চার দিকের খবর থেকে নিশ্চিত, সাম্প্রতিক শিক্ষাচিন্তার দুটো প্রধান দিক রয়েছে। এক, পড়াশোনা কী ভাবে চলবে? আর দুই, পরীক্ষা কী ভাবে সম্পন্ন হতে পারে? এই দু’দিকের সঙ্গেই যুক্ত সিদ্ধান্তগুলির একটি তাৎক্ষণিক, অন্যটি সুদূরপ্রসারী। ভাবনার কথা, সুদূরপ্রসারী দিকগুলি আপাত ভাবে কারও চোখে পড়ছে না। এই বিষয়ে ভাবনার এবং প্রশ্ন করার জায়গা থেকে যাচ্ছে।
পরীক্ষা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যথাযথ পঠনপাঠন। শিক্ষার উদ্দেশ্য তো পরীক্ষা-দেওয়া আর পরীক্ষায় পাশ-করা নয়, পড়াশোনা-করা -এই পুরোনো দরকারি কথাটাকেই যেন ভুলতে বসেছি আমরা এই সংকটকালে। মোবাইল বা ল্যাপটপের এ-পারে একজন শিক্ষক কিছু কথা বললেন, পর্দার ওপারে কিছু ছাত্রছাত্রী তা শুনল, তা উচ্চশিক্ষার একটি সুন্দর সহায়ক ব্যবস্থা হতে পারে তবে বিকল্প ব্যবস্থা নয়। মনে রাখতে হবে, সারা দেশে, উন্নততম যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হলেও শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র পথ হতে পারে না। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক, একজন শিক্ষকের সঙ্গে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীদের চোখের যোগাযোগটাও খুব দরকারি। কারণ, শিক্ষকতা তো শুধু শিক্ষাদান নয়, শিক্ষাগ্রহণও। নৈর্ব্যক্তিক ভাবে টানা পড়িয়ে-চলা নয়, শ্রোতা-ছাত্রছাত্রীমণ্ডলীর প্রত্যেকে কে কতটা গ্রহণ করতে পারছে, তার উপরেও নির্ভর করে পড়ানো। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর গ্রহণক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষককে প্রতি মুহূর্তে তাঁর বলাকে তৈরি বা সৃষ্টি করতে হয়। শিক্ষক-ছাত্রের এই মানবিক আন্তঃসম্পর্কটিও শিক্ষকতারই অঙ্গ।
একে তো আমাদের রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশা, তার ওপর আবার করোনা সংকটে অনলাইন শিক্ষা চালু হলে মানব সম্পদ শক্তিশালী হওয়া তো দূরের কথা বরং সেই সম্পদ দেশের আর তেমন কোনো কাজেই আসবে না হয়তো!
এরই মধ্যে বহু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আর সেই ক্লাস চলছে বৈষম্যের চিরাচরিত রীতি মেনেই। অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নাম না-জানা অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী । কীভাবে ? পশ্চিমবঙ্গের নিরীখে তা বোঝার চেষ্টা করা যাক-
১) গত তিনমাস যাবৎ লকডাউনের জন্য অসংখ্য দিন-আনা, দিন-খাওয়া মানুষের কাছে 4G নেট ব্যবহার আকাশের চাঁদ ধরতে চাওয়ার সমান।
২) ডিজিটাল ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপন যতই রংচঙে হোক না কেন, এখনও অধিকাংশ বাড়িতে স্মার্টফোন নেই। সংসারের টানাটানির চোটে সে ফোন ব্যবহার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বাতুলতা। সেটা শহরের বস্তি অঞ্চলের পরিবারগুলো থেকে শুরু করে গ্রামের পরিবারগুলিতে অনেকেরই অ্যানড্রয়েড ফোন ব্যবহার করার সামর্থ্য নেই। কোনো কোনো পরিবারে হয়তো খুব জোর একটা কী প্যাড ফোন থাকতে পারে। তা দিয়ে তো আর অনলাইন ক্লাস করা যায় না।
৩) ইন্টারনেট পরিষেবা, নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার ‘অতি-সক্রিয়তার’ (বেহাল দশা) কথা তো সকলেই জানেন।
৪) আমফান পরবর্তীতে যেখানে এখনো কয়েক হাজার মানুষের মাথায় ছাদ নেই। সেখানে অনলাইন ক্লাস করার কথা চিন্তা করা মানে হাসির খোরাক হওয়া। আর এর ফলাফল ? প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের জেরে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তারা, আর গিয়ে দাঁড়াচ্ছে অনিশ্চয়তার খাদের কিনারে। দেশের GDP ভেঙে পড়ার মতোই ভেঙে পড়ছে ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাস্তবতা।
যে সময় গোটা দেশ উত্তাল অভিনেতার মৃত্যু থেকে চিনা সামগ্রী বর্জনে, ঠিক তখনই অন্ধকার ভবিষ্যতের কাছে হার মেনে নেয় অনলাইন ক্লাস করতে না পারার অবসাদে। বালির শিবানী সাউ, কলকাতা থেকে অনতিদূরে মফঃস্বল এলাকার ক্লাস টেন – এর ছাত্রী। বাড়ির একমাত্র স্মার্টফোনটি নিয়ে বিহারে দেশের বাড়িতে গিয়ে লকডাউনে আটকে পড়েছিল বাবা-মা। দাদার সাথে থাকছিল ভাড়া বাড়িতে। সামনে মাধ্যমিক এর মধ্যে অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত , টানা চার মাস গৃহশিক্ষক থেকে বিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগের অভাবে পড়াশোনার ক্ষতির চিন্তা করে অবসাদের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে শিবানী। শিক্ষা ব্যবস্থার চরম একমুখী বৈষম্যের শিকার সে। আরো হাজার হাজার অন্ধকারে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিধি সে। যাদের কথা ভেবে শিক্ষানীতি গঠন হয়না, যাদের কথা ভেবে শিক্ষাব্যবস্থা টিঁকে থাকে না। এখন প্রশ্ন আসে শিবানী আত্মহত্যা করলো কার প্ররোচনায় ? চোখে আঙুল দিয়ে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিতে হবে না সেটা। মুনাফাসর্বস্ব পৃথিবীর একটা মাধ্যম এখন শিক্ষা। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই একটা ব্যাবসায়িক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। শিক্ষা যেখানে মৌলিক অধিকার সেখানে , শিক্ষার সঠিক সুযোগ না পেয়ে আত্মঘাতী হয়েছে শিবানী। আসলে তো এটা আত্মহত্যা নয়, একটি প্রাতিষ্ঠানিক খুন! মৌলিক অধিকারের জন্য প্রয়োজন বৃহত্তর লড়াই। ছাত্র-ছাত্রী সমাজের স্বার্থে এই লড়াই সাধারণ মানুষকেই লড়তে হবে। ভবিষ্যতে আর কোনো শিবানী যাতে প্রতিষ্ঠানিক হত্যার শিকার না হয়, তার জন্যে নিরলস লড়াই জারি রাখতে হবে।
অনলাইন নাকি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মুখোমুখি পঠন-পাঠন? কোরোনা আবহে শিক্ষার ভবিষ্যত কী???
Comments
2 responses to “অনলাইন নাকি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মুখোমুখি পঠন-পাঠন? কোরোনা আবহে শিক্ষার ভবিষ্যত কী???”
-
Everything is very open with a precise description of the issues. It was really informative. Your website is very helpful. Many thanks for sharing!
-
It’s in point of fact a great and useful piece
of information. I am happy that you simply shared
this helpful info with us. Please keep us up to date like this.Thanks for sharing.
Leave a Reply