৫ নং

সল্টলেকের 5no. TANK AF block Sector-1 Pin -700064-এ এই ঝুপড়ি-বস্তি।

ভাবা রিসার্চ সেন্টারের দেয়ালের গা ধরে প্লাসটিক, বাঁশ দর্মার বেড়ার ঝুপড়ি।  সবমিলিয়ে 40 টি পরিবার থাকেন। মহিলারা সল্টলেকের ধনীলোক বাবুদের বাড়ি শ্রম দেন, গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। পুরুদের অনেকে রিক্সা চালান, যোগানদার বা রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, কেউবা হকারি করেন, কেউবা সিকিউরিটি গার্ডের কাজ করেন।  এনারা এসেছেন  মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, বসিরহাট, দক্ষিণ 24 পরগণার মথুরাপুর, রায়দীঘী, ক্যানিং, সুন্দরবন থেকে, পেটের দায়ে, কাজের জন্য। এমনকি উড়িষ্যা থেকেও এসেছে কয়েকটি পরিবার। বাধ্য হয়ে অন্ধকার ঘুপচি ঘরে বিদ্যুৎহীন, শৌচালয়হীন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবন যাপন করেন। গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে এই বস্তির বাচ্চা-বুড়ো সবাই আশেপাশের বট গাছ, আম গাছের তলায়, রাস্তার ওপর দিনের বেলায় ঘুমান,তাস/লুডো খেলেন, প্রকৃতির হাওয়ায় সময় কাটান। বাথরুম, পায়খানা ঘরের সমস্যাও আছে। বিশেষ করে এব্যাপারে মহিলাদের কষ্টকর জীবন কাটাতে হয়।

প্রথমবার আসলে অন্ধকারে হোঁচট খেতে পারেন।  মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে হাঁটুন, তালে আর অসুবিধা হবে না।

মাঝখানে অন্ধকার  সরু গলি, গলির দুধার ধরে লম্বা করে  গায়ে গায়ে সার বেধে ঘুপচি ঘুপচি ঘর। আসুন, আসতে আসতে হাঁটুন।  হাঁটতে হাঁটতে প্রবেশ করে যাবেন গলির অনেকটা ভেতরে, যেতে যেতে টের পাবেন দুপাশের ঘুপচিগুলিতে কারা যেন কথা বলছে, দেখতে পাবেন অন্ধকারে লম্ফ জ্বালিয়ে কাজ থেকে ফেরা মানুষগুলো ভাত খাচ্ছেন; সেদিনের শেষ আহার। গলির ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই শুনতে পাবেন বাচ্চাদের চেঁচা মেচি, শোরগোল, পঠনপাঠনে রত একাধিক বাচ্চার কন্ঠস্বর! হ্যাঁ, এখানেই থামুন। আপনাকে স্বাগত। এটাই আমাদেরসল্টলেক 5 নং ট্যাঙ্ক সংহতি ইস্কুল। মাথা নিচু করে প্রবেশ করুন, দেখবেন আপনার বাড়ির রুমের উজ্জ্বল আলোর মতো না হলেও অল্প আলোতে কচিকাচারা পড়াশোনা করছে। দিনের বেলা সোলার প্যানেল চার্জ দেওয়া সঞ্চিত শক্তিতে রাতেরবেলা আলো জ্বলছে। বসুন, আলাপ করুন বাচ্চাদের সাথে, কথা বলুন, ওরা খুশি হবে। আপনারও ভালো লাগবে।  রহমান শেখ, আমিনুর শেখ, সাহিল গাজি, আজমীরা খাতুন, বর্ষা পাইক, মঙ্গল পাইক, সঙ্গীতা নস্কর, তিতলি ওঁরাও, সত্য ওঁরাও, প্রসেনজিৎ হরিজন, সোনামণি হালদার, হিরণ সর্দারসবাই একসাথে পড়াশোনা করছে। কেউ সবে সবে বর্ণমালা চিনছে, কেউ গুনভাগ করা শিখছে, কেউবা পৃথিবী কীভাবে লাট্টুর মতো পাক খেতে খেতে সূর্যের চারিদিকে ঘোরেসেটা স্যারের কাছে শুনছে, বুঝে নিচ্ছে।

শনিবার, রবিবার, সোমবার  বাদ দিয়ে সপ্তাহের আর বাকি সন্ধ্যাবেলা গুলোতে 6 টা থেকে 8 টা, কখনো বা 9 টা পর্যন্ত ব্চ্চাদের ক্লাস চলে।

রবিবার দিনও ক্লাস হয় তবে সেটা সকালবেলা।  আর সোমবার দিন এইসব বাচ্চাদের মায়েরা এবং ঝুপড়ির মহিলারা লেখাপড়া শিখতে আসেন। পড়াশোনার সাথে সাথে ওরা আঁকতে, খেলতে আর সিনেমা দেখতে ভালোবাসে। রবিবার দিনটা মাঝে মধ্যে খেলাধূলাও হয়। কাছাকাছি কোনো আবাসনের মাঠে ফুটবল কিংবা ক্রিকেট খেলাও হয়। এখানে যে শিক্ষকশিক্ষিকারা বাচ্চাদের পড়াতে আসেন তারাও কোনো না কোনো বস্তিতেই থাকেন। ভবিষ্যতেও আমরা চাই এখন যেসব বস্তিতে আমাদের সংহতি ইস্কুল চলছে, সেখানকার ছাত্ররা বড় হয়ে অন্য আরেকটি বস্তিতে গিয়ে সেখানকার পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের পড়াবে, শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করবে। এখানে পড়তে আসা বাচ্চারা সকলেই শ্রমজীবী পরিবারের, দিন আনা দিন খাওয়া, লেখাপড়া না জানা, মাবাবার সন্তান। তাই পরিবারের বড়োরা ছেলে মেয়েদের পড়াশোনার বিষয়ে বিশেষ যত্ন নিতে পারেন না। তাই বেশীরভাগ বাচ্চারাই ঠিক মতো বাংলা পড়তে পারে না, যোগবিয়োগ, গুণভাগ পারেনা।অথচ রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থানুযায়ী শ্রেণীর পর শ্রেণী পাশ করে যায়।শেষ পর্যন্ত মাধ্যমিকটা কেউ-কেউ টেনেটুনে পাশ করলেও উচ্চশিক্ষার দোর গোড়ায় অনেকেই পৌঁছাতে পারে না। অর্থনৈতিক কারণে স্কুলছুট তো আছেই। তার সাথে  পূর্বের শ্রেনীগুলোর পাঠ ভালোভাবে আয়ত্ত না করেই উঁচু ক্লাসে উঠে বেসামাল হয়ে পড়ে, হীনমন্যতায় ভোগে। সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে শ্রেণী পর শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেও আসলে এরা পিছনেই থেকে যায়যার ফল, স্কুলছুট। নিজেরাও একরকম ভাবে বুঝতে পারে তারা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের থেকে পিছিয়ে, উঁচু ক্লাসে পড়ার যোগ্যতা নেই, তাদের মাবাবারাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, মনে করেন, তাদের সন্তানদের দ্বারা বেশী দূর লেখাপড়া হবে না, তার চেয়ে বরং কাজ করুক, দুটো টাকাপয়সা রোজগার করে সংসারে সাহায্য করুক। এইভাবেই বস্তির বাচ্চারা, শ্রমজীবী পরিবারের বাচ্চারা পড়াশোনা থেকে দূরে সড়ে যায়। তাই আমরা এইসকল পিছিয়ে পড়া বাচ্চাদের যোগ্য করে তুলতে, তাদের আত্ম বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে তাদের খামতি গুলোকে পূরণ করার চেষ্টা করি।

প্রায় দুবছর হতে চললো 5 নং সংহতি ইস্কুলের বয়স।

প্রথাগত পাঠক্রমের বাইরে যাতে অন্যান্য বই পড়ার সুযোগ পায়, পড়াশোনাকে যাতে ভালোবাসতে শেখে তার জন্য একটি ছোটো লাইব্রেরীর ব্যবস্থাও আছে। যেখান থেকে নিজেদের পছন্দ মতো গল্পের বই, বিজ্ঞান শিক্ষার বই পড়তে পারে। আমরা যারা এই উদ্যোগে সামিল, ইস্কুল চালাতে গিয়ে, বাচ্চাদের পড়াতে গিয়ে বস্তির মানুষদের সাথে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে আমরাও অনেক কিছু শিখেছি, জেনেছি। নতুনভাবে অনেক কিছু করার প্রেরণাও পেয়েছি। এই উদ্যোগে এই ঝুপড়ির খোকন সর্দার, সুজয় সর্দার মানোয়ারা বিবি, রুলামিন, আলীএরাও তাদের সাধ্যমতো দায়িত্ব পালন করে, সংহতি ইস্কুল পরিচালনায় অংশ নেয়। সেটা স্কুল ঘর তৈরী করা, বাচ্চাদের ডেকে আনা,বাচ্চাদের সিনেমা দেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা, ইস্কুলটা কীভাবে আরো ভালোভাবে চালানো যাবে তার জন্য মিটিং করাসব রকম কাজেই মিলেমিশে সহযোগিতা করেন। পড়াশোনা, খেলাধূলা, সিনেমা দেখার পাশাপাশি বছরের বিভিন্ন সময় মহাপুরুষদের জন্মদিবস পালন, কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভিডিও ক্লিপ বা সিনেমা দেখানো, গল্প বলাএগুলোও করা হয়। আগামী দিনে পরিকল্পনা আছে  সংহতি ইস্কুলের সকল বাচ্চাদের চিড়িয়াখানা বা শিক্ষামূলক স্থানে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, কলকাতা মিউজিয়াম বা কোনো ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করা, বাচ্চাদের লেখা, ছড়াকবিতা আঁকা নিয়ে একটা ম্যাগাজিন বার করা।

Leave a Message :

Want to make financial Contribution?

OR
For Automated Regular Contributions