“লেখা-পড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে।”
না, বাংলা তাদের মাতৃভাষা নয়। তাই এই কথাটিও যে কোনদিন শুনেছে সেকথা হলপ করে বলা যাবে না। তবে কিনা তিন পুরুষের কলকাতা বাস। তাই ব্যস্ত ব্রীজের উপর দিয়ে অবিরাম চলতে থাকা দামি দামি গাড়িগুলো ব্রিজের তলায় থাকা শিশুদের কানে কী কথা যে বলে যায় বা যেতে পারে তাই বা কে বলতে পারে? তবে সে সব কথা এখন অতীত। ব্রীজের তলা ছেড়ে এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে খালের ধারে। আর জি কর থেকে যে রাস্তাটি ভাগ হয়ে একদিকে চলে যায় কলিকাতা স্টেশন অন্যদিকে খালের দুই শাখা ধরে সল্ট লেক আর মানিকতলা, সেই মোড়ের মাথায় এখন ৩৬টা কালো প্লাস্টিকের ঘর। গ্রীষ্ম-বর্শা-শীত কোন কালেরই উপযুক্ত কিনা সে জানেন কেবল কলকাতা করপোরেশান। তার মধ্যে আবার আজকাল প্রতিবছরই একটা দুটো “সাইকোলন” না কী একখান আসে আর ঘরগুলো একটু একটু করে ঝুঁকে পড়ে। বাবাগুলো রিক্সা চালক, করপোরেশান এর অধীনে ঠিকায় কাজ করা জমাদার বা ফুচকাওয়ালা। মাগুলো কাজ করে বাবুদের বাড়ি বা হোসিয়ারি কারখানায় অথবা সাফাইয়ের কাজ। এই ভাবেই বেড়ে উঠছে কিছু ছোট ছোট শিশু। গাড়ি ঘোড়া এদিকেও দেখা মেলে তবে তার থেকে বেশি চোখে পড়ে মজে যাওয়া খালের পাশে শুয়োরের চাষ।
তাই বলে কী পড়াশুনাও চলে যাবে পাঁকে গড়াগড়ি খেতে?
মোটেও না! বস্তিতে সংহতি ইস্কুল গড়ে তোলার পথে প্রত্যেক জায়গাতেই শুরুর দিকে যে সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হল বাবা মা বা শিশুদের মধ্যে সচেতন আগ্রহের অভাব। তবে এই সমস্যা এখানে নেই। বরং এদের স্বপ্ন শুনেই অনেকে হিমসিম খাই। প্রায় যেন বামনের চাঁদে চড়ার ইচ্ছে। তাই বলা যায় প্রায় নাছোড়বান্দা প্রয়াসের জোরে এখানকার বাসিন্দারা নিজেরাই গড়ে তুললেন এই ইস্কুল। বাধা কম ছিল না। প্রথমত জায়গা বলতে খালের ধারে করপরেশানের বড় জলের পাইপের পাশে একখান গর্ত। প্রায় এক ভাঙ্গা বাড়ি সমান রাবিশ ফেলে সেই গর্ত ভরা যেন রামায়ণের সেতুবন্ধন। পুরুষ-মহিলা-শিশু তিনের শ্রমের ফল। শেষে যখন প্রথম বাঁশটি পোঁতা হল সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হলেন ভোটের সময় নেতার পাশে দেখা দেওয়া পার্টির দাদারা। সঙ্গে রাস্তায় ফুচকা বিক্রি করার জন্য হপ্তা চাওয়া পুলিসমশাই। এখানে নাকি বিরোধীরা পার্টি অফিস বানাচ্ছে। এতো আস্পর্ধা তাদের ধম্মে থুড়ি কম্মে শয়? যাই হোক। আন্দোলনের অভ্যেস সন্ধ্যাদি বা মুস্তাফা দা-দের সেই ব্রিজের তলা থেকে বিতাড়িত হয়ে এখনকার মাথা গোঁজার ঠাইটুকু পেতে গিয়েই হয়ে গিয়েছিল। তাই আবারো আন্দোলনে অসুবিধে হয়নি। আর মাঝে থেমে থাকেনি ইস্কুল। অপরিসমাপ্ত কাঠামোর মাঝে খোলা আকাশের নিচেই শুরু হয় পড়াশুনা। দীর্ঘ ৩ মাস লড়াই মারফৎ সব বাধা অতিক্রম করে শেষমেশ গড়েই উঠল সংহতি ইস্কুলের প্রথম হিন্দি মিডিয়াম শাখার ইস্কুল ঘর। আপাতত এখানে হপ্তায় ৪ দিন পড়াশুনা চলছে এবং হলপ করেই বলা যায় চলছে বড়ো হওয়ার, মানুষের মতো বেঁচে থাকার জন্য লড়াই। যে লড়াইয়ের পেছনে আছে একা একা গাড়ি চাপার স্বপ্ন নয়, একসাথে সবাই মিলে ভালো থাকার স্বপ্ন।