Category: Uncategorized

  • আমি যেভাবে চেষ্টা করছি

    আজ মঙ্গলবার (26/10/21)-এ 5 নং সংহতি ইস্কুলে পড়াতে গিয়ে শ্রেণী ভিত্তিক আলাদা আলাদা করে না পড়িয়ে একসাথে একটাই বিষয়ে নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করলাম। আজকে বাচ্চাদের উপস্থিতির সংখ্যা ছিল ১৪ জন। এর মধ্যে তিনজনকে পড়াচ্ছিল ৫ নং বস্তিরই ছেলে সুজয়। আমি বাকি ১১ জনকে নিয়ে বাংলা রিডিং কীভাবে পড়তে হয়, কোন শব্দের কী উচ্চারণ হয়, যুক্তাক্ষরগুলো কীভাবে আলাদা আলাদা দুটো বর্ণ যুক্ত হয়ে উচ্চারিত হচ্ছে বা বইতে যেভাবে লেখা আছে সেটাকে ভাঙলে আমরা আলাদা আলাদা কী কী বর্ণ পাচ্ছি সেইটাকে খুঁজে বার করা- এইসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

    এটা শুরু করার সময়, বর্ষা নামের একটি মেয়ে কিছু মনে পড়ায়, নাম ডাকার খাতাটা খুলে পিছন দিকের পাতায় কতকগুলো নামের তালিকা দেখালো আর বললো, ‘স্যার, আনন্দ স্যার, এইটা দেখতে বলেছে, আমরা যারা রিডিং পড়তে পারি না তাদের নাম লেখা আছে, আমার নামও আছে; আমিও পারি না পড়তে।” ঐ তালিকায় থাকা ৫-৬ জনের মধ্যে দু’একজনই আজকে উপস্থিত ছিল। তার মধ্যে একজন তো মাঝপথে পড়া ছেড়ে আজকে পালিয়েই গেলো। 

     যাই হোক, বাংলা রিডিং পড়তে পারে না, বানানের সমস্যা, যুক্তাক্ষর বুঝতে অসুবিধা, বর্ণ ঠিক মতো না চিনতে পারা, রিডিং পড়ে অর্থ বুঝতে না পারা-এই ধরনের সমস্যা আমাদের সবকটি সংহতি ইস্কুলের বাচ্চাদের মধ্যেই কম-বেশী আছে। তাই আজকের পড়ানোর অভিজ্ঞতাটা আর সকল সংহতি ইস্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছি, যদি কারও মনে হয় এটা কার্যকরী, তাহলে যাতে তারাও তাদের পড়ানোর কাজে এমনই কিছু পদ্ধতির মধ্য দিয়ে বাচ্চাদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত এবং তার সমাধান করতে পারে। সংহতি ইস্কুলে আলাদা আলাদা শ্রেণীর বাচ্চারা আসে, তাতে করে একজন কি দুজন টীচারের পক্ষে একসাথে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর ভিন্ন ভিন্ন বিষয় পড়ানোটা চাপের হয়! পিছিয়ে পড়া যারা তাদের খামতিগুলো মেটাতে একসাথে সবাইকে একটাই বিষয় পড়ানোটা সুবিধে, যাদের সমস্যাগুলোও এক। কিন্তু গতানুগতিক পড়াশোনা, স্কুলের বই ধরে ধরে পড়ানোর ঝামেলা-ঝক্কিতে আর সুযোগই পাওয়া যায় না এমন একটা ক্লাস করার, যেখানে একটা বিষয়ের ওপর ফোকাস করে পিছিয়ে পড়াদের একটু এগিয়ে নেওয়া যাবে! 

    এই সমস্যা আমারও হয়, এই চাপ আমিও খাই। কিন্তু এইসব সমস্যা, চাপের মধ্যেই নিজেকে সুযোগ খুঁজে নিতে হবে, সময় বার করে নিতে হবে।

    আজকে ৫ নম্বর বস্তিতে পড়াতে গিয়ে দেখলাম ক্লাস 7 থেকে 9-10- এর ছাত্র-ছাত্রীদের কেউই আসেনি। যারা এসেছে তারা ক্লাস 2 থেকে 6 এর মধ্যে কিন্তু এদের সকলেরই সমস্যাটা একইরকম। সমস্যাটা কী? এদের কেউই ঠিক মতো বাংলা পড়তে পারে না, যেটাকে আমরা অনেকেই রিডিং পড়তে পারে না বলে চিহ্নিত করি। তাই আজকে আমি শ্রেণী ভিত্তিক না পড়িয়ে একই সমস্যাযুক্ত বাচ্চাদের একসাথে রিডিং পড়ানো, বানান শিক্ষা দেওয়ার ক্লাস শুরু করলাম। যদিও রিডিং পড়ার অনেকগুলো রকমফের আছে। আজকে পড়াতে পড়াতে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। কেউ কেউ বর্ণের সাথে আ-কার, হ্রস্ব-ই কার উচ্চারণ করে ধরে ধরে বানান করে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারে,( পড়াটা খানিকটা এমন হয়- এ, ত-এ ও-কারে তো, য়-এ আ-কারে য়া — ‘এতোয়া’, ম- এ হ্রস্বু কারে মু, দন্তন ন এ ড এ আ কারে –‘মুন্ডা’, ‘র’ মুন্ডার, ক এ আ-কারে কা, হ এ হোস্সি কারে হি, নএ দীর্ঘীকারে নী– ‘কাহিনী’) তারপর একটা, তারপর আরেকটা- এইভাবে পড়তে পড়তে সে আগের শব্দটা কী পড়েছিল সেটাই ভুলে যায়, তাই গোটা একটা বাক্য ঐভাবে পড়ে শেষ করার পর, কী তার অর্থ দাঁড়ালো সেটাই বুঝে উঠতে পারে না। কেউ কেউ আবার এইভাবেও পড়তে পারে না, বর্ণগুলোই চিনতে পারে না, যে কারণে শব্দ গঠনে তাদের অসুবিধা হয়। কেউ কেউ আবার আ-কার, হ্রস্বি- কার মুখে উচ্চারণ না করেই একেবারে একটা গোটা শব্দ উচারণ করে ফেলে। এইভাবে পর পর শব্দ পড়ে পড়ে গোটা একটা বাক্য পড়তে পারে। এরা আগের দেওয়া দুটো উদাহরণের বাচ্চাদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। এরা এইভাবে পড়ে একটা সম্পূর্ণ বাক্যের অর্থটা কী দাঁড়ালো একটু হলেও ধারণা করতে পারে বা বুঝতে পারে। 

     আজকে ৫ নং বস্তির সংহতি ইস্কুলের বাচ্চাদের পড়াতে গিয়ে উপরের উদাহরণগুলোর মধ্যে একটি বাচ্চাকেই( সঙ্গীতা নস্কর- ক্লাস- 6) পেলাম যে আ-কার, হ্রস্ব-ই কার উচ্চারণ করে করে নয় বা বর্ণ ধরে ধরে নয়, একেবারে একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে, এরকম পর পর শব্দ পড়ে সম্পূর্ণ একটা বাক্য পড়তে পারছে দাঁড়ি, কমা সহ। কমার জায়গায় অল্প থেমে, পূর্ণচ্ছেদ বা দাঁড়ির জায়গায় সম্পূর্ণ থেমে বাক্যগুলো পড়ছিল মেয়েটি। এইভাবে পড়া দেখে বুঝতে পারলাম মেয়েটির যতিচিহ্নের অল্প-বিস্তর জ্ঞান আছে এবং গোটা একটা বাক্য পড়ে তার অর্থটাও ধরতে পারছে বা বুঝতে পারছে। পরে শুনলাম মেয়েটির মা অল্প শিক্ষিত হলেও, মেয়েটিকে তার মা নিয়মিত কাছে নিয়ে পড়তে বসান, তার সাধ্য মতো মেয়েকে পড়াশোনায় সাহায্য করেন, দেখিয়ে দেন। তবে সবার ক্ষেত্রে তো এমনটা হয় না! তাদের কী হবে! তাদেরকেই আমাদের গাইড করতে হবে, তাদের জন্য সহজ, সঠিক পদ্ধতি খুঁজে বার করতে হবে যাতে তাদের খামতিগুলো পূরণ করতে পারি। সঙ্গীতা ছাড়া, তিতলি ওঁরাও একেবারে ঠিকঠাক না হলেও অন্যান্যদের থেকে ধরে ধরে মোটামুটি পড়তে পারছে, আরেকটু ওর পিছনে সময় দিলেই ভালো পড়তে পারবে। ‘হিরণ সর্দার’ – এই ছেলেটির সমস্যাটা একটু অন্যরকম। ও ভালোই পড়তে পারে কিন্তু বানান যা লেখা আছে ও সেই মতো শব্দগুলো উচ্চারণ করে। যেমন ‘কচি’- এই শব্দটির উচ্চারণ করি আমরা কোচি। কিন্তু হিরণের যুক্তি কই কোচি তো লেখা নেই, লেখা আছে ক অ চি । যেখানে ‘করল’ লেখা আছে অর্থাৎ কোরলো সেটাকে ও পড়ছে করোল বা ক র ল -এইভাবে। খেলা থাকলে খ্যালা না বলে ও বলছে খেলা( হিন্দিভাষীদের মতো করে)। আরেকটি বাচ্চা সুদীপ নস্কর, বর্ণ বা শব্দের সাথে থাকা আ-কার হ্রস্ব-ই কার উচ্চারণ করার সময় এইভাবে পড়ছে- হ-এ আ-কারেতে হা, ত-এ হোস্সি- কারেতে তি তালব্য শ-এ আ-কারেতে শা – অর্থাৎ কারের সাথে তে ধ্বনিটা থাকবেই। মঙ্গল সর্দার নামের একটি বাচ্চার উ আর ই নিয়ে গণ্ডগোল! উ থাকলে ই পড়ছে। ‘তাতেই’ শব্দটা পড়তে গিয়ে ত এ আ-কার, ত এ কার হোস্সু বলে তারপর আবার গোটা শব্দটার উচ্চারণ ঠিকই বলছে- ‘তাতেই’। এর নাম নিয়ে কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি, কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। এখানে এই গদ্যটাতে যে এতোয়া নামের আদিবাসী ছেলেটির কথা আছে তার দাদুর নাম এখানে আছে মঙ্গল; তাই বদমাশগুলো ওর পিছনে লাগা শুরু করে দিল, “এ মঙ্গল, এতোয়া তোর নাতি? তুই আদিবাসী দাদু?” মঙ্গলও কম যায় না, ও বলে দিল, দেখেছিস বে আমার নাম বইতে আছে, তোদের নাম আছে?” 

    যে সব শব্দের বানানে চন্দ্রবিন্দু আছে, যেমন ‘চাঁদ’,

    এই শব্দটি বানান করে পড়তে গিয়ে কেউ কেউ চন্দ্র বিন্দু উচ্চারণ করতে ভুলে যাচ্ছে, কেউ কেউ আবার বুঝতে পারছে না চন্দ্রবিন্দু আগে উচ্চারণ করবে না চ আগে উচ্চারণ করবে, অনেকেই পড়ছে, চ-এ আ-কারে চন্দ্রবিন্দু দ, আসলে যেটা পড়তে হবে চ-এ চন্দ্রবিন্দু আ-কার, দ- চাঁদ।

    যাই হোক, তালে কী দাঁড়ালো? একইরকম সমস্যা আছে, এমন পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে একসাথে বাংলা পড়া বা রিডিং পড়াটা শিখবো কিন্তু এখন দেখছি সমস্যার ভিতরে আরও সমস্যা। সেখানেও দেখছি ভিন্নতা, কম- বেশীর পার্থক্য। 

    আসলে আমাদের এই সমস্যা বা ত্রুটিগুলোকেই চিনতে হবে, বাছতে হবে একইরকম সমস্যা আর কোন কোন বাচ্চার আছে। সমস্যা যেমন আছে তার সমাধানও আছে। খুঁজতে হবে সেই সমাধানগুলোকে। এই খুঁজতে গিয়েই আমাদেরও অনেক কিছু শেখা হয়ে যাবে। এক একটি বাচ্চার সমস্যা আবার তার মতো করে আলাদা, যাকে কোনো ক্যাটাগরিতেই ফেলা যায় না। তার সমাধানও খুঁজতে হবে তার মতো করে। তাকে সময় দিতে হবে, সমস্যার গভীরে নেমে সমাধানের পথ খুঁজে বার করতে হবে। 

    তো যাই হোক, এইদিন সবাইকে একসাথে রিডিং পড়াতে গিয়ে সমস্যাটা যেটা হচ্ছিল, আলাদা আলাদা ক্লাস, আলাদা আলাদা বই ; তাই পড়ানোর সুবিধার্থে যে কোনো একটা ক্লাসের বাংলা বই দিয়ে পড়ানো শুরু করলাম। হাতের সামনে পেলাম ‘ ‘পাতাবাহার’ – পঞ্চম শ্রেণীর বাংলা পাঠ্য বই।

     

     এই বইটায় থাকা কোন্ গল্পটা দিয়ে পড়ানো শুরু করবো মানে রিডিং পড়াটা প্র্যাকটিস করবো ভাবছি, খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতে পেলাম, মহাশ্বেতা দেবীর লেখা ‘এতোয়া মুন্ডার কাহিনী’। এইটাই বেছে নিলাম একসাথে পড়বার জন্য।

      

    এইটাই বেছে নিলাম কারণ, এইটা রিডিং পড়াটা প্র্যাকটিস করার পর এর পাশাপাশি আদিবাসী সাঁওতাল, মুন্ডাদের সম্পর্কে, ইংরেজ, জমিদারদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই- বিদ্রোহ সম্পর্কে গল্প বলা যাবে বলে। এই গদ্যটা পড়তে গিয়েই একটা বাচ্চা তার অপরিচিত একটা শব্দ পেয়ে প্রশ্ন করেছে- ‘ উলগুলান কী স্যার? আরেক জন প্রশ্ন করলো ‘হুল’ কী স্যার? তখনকার মতো ওদের থামিয়ে রিডিং পড়াটা কনটিউ করলাম নইলে ব্যাঘাত ঘটবে মাঝখানে গল্প বসতে বললে। পরে অবশ্য এই রিডিং পড়াটা শেষ করে ওদের প্রশ্নের উত্তর দিলাম, ওদের মতো করে। ইতিহাসের গল্পগুলোও শোনালাম, টুকরো টুকরো কিছু গল্প। তাছাড়া এই গদ্যটাতে এমন কিছু শব্দ আছে, যা ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে এবং ব্যবহারিক শব্দ, যেগুলো মনের ভাব প্রকাশ করতে, কোনো কিছু লিখতে গেলে কাজে আসবে এবং অন্য কোনো গদ্য পড়তে গেলেও এই শব্দগুলো ফিরে ফিরে আসে। যেমন- গ্রাম, জমিদার, পূর্বপুরুষ, আইনকানুন, সরকার, জোরজুলুম, লেখাপড়া, বন, আদিবাসী, সাঁওতাল, মুন্ডা, যুদ্ধ, দেশ, বাংলা, বিহার, ওড়িশা, আসাম- এমনই কিছু শব্দ। তাই এটাকে রিডিং পড়াবার জন্য বেছে নিলাম। 

    রিডিং পড়বার এই ক্লাসে আজকে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই যে প্রথমেই উৎসাহ দেখালো বা পড়তে রাজী হলো এমন নয়। ওরা যে ভাবে পড়তে অভ্যস্ত, অর্থাৎ স্যার পড়িয়ে দেবে আমরা শুনবো, প্রশ্নের উত্তরগুলো স্যার খুঁজে বার করে দেবে আমরা লিখবো। এখন স্কুলগুলো ছুটি থাকায় স্কুলগুলো থেকে বিভিন্ন বিষয়ে যে model activity tusk গুলো বাচ্চাদের দেওয়া হয়েছে সেগুলো করতেই তাদের উৎসাহ বেশী। কেউ বললো স্যার আমাকে ইতিহাসের এই প্রশ্নগুলো লিখিয়ে দাও, কেউ বললো স্যার বাংলার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না বা লিখতে পারছি না, আপনি বলে দিন কী হবে! স্কুল থেকে দেওয়া এই tusk গুলো তো করতেই হবে, ওরা না পারলে দেখিয়েও দিতে হবে, সাহায্য করতে হবে। কিন্তু ওদের এই tusk গুলো করাতে গিয়ে দেখেছি, যে যে বিষয়ের অধ্যায়ের থেকে বা বাংলার কোনো গল্প, কবিতা থেকে প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো তাদের পড়াই হয়নি। জানেই না কোন অধ্যায় থেকে বা কবিতা, গল্প থেকে প্রশ্নটা দেওয়া হয়েছে। যে ছাত্র বা ছাত্রীটা কোনও গল্প পড়েনি বা অধ্যায়টা সম্পর্কে ধারণাই নেই, পরিচিত নয়, কখোনো শোনেইনি সেই বিষয়ে- সে কী করে সেখান থেকে তৈরী করা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বার করে প্রশ্নের মান অনুযায়ী গুছিয়ে লিখবে! আগে তাকে অধ্যায়টা পড়াতে হবে, গল্পটা পড়ে শোনাতে হবে বা ওরা নিজেরাই পড়বে, তাহলে ওরা নিজেরাই পাঠ্য বইগুলো থেকে উত্তর খুঁজে লিখতে পারবে। অথচ স্কুলগুলো থেকে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে এই গুলো লিখে জমা দিতে বলা হয়। তার একটা তাড়া থাকে। বাচ্চারা তাই যে করে হোক, যার কাছ থেকে হোক, এইগুলোর উত্তর লিখিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাতে ঐ তারিখের মধ্যে জমা দিতে পারে। আমরা অনেকেই নিরুপায় হয়ে এই activity tusk গুলো বলে দিয়েছি, করিয়ে দিয়েছি। ওরা আমাদের কথা অনুযায়ী কপি করে গেছে। কিন্তু এই করে বাচ্চারা কোনও বিষয়টাই সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না, শিখতে পারছে না। যখন ওদের বলা হচ্ছে প্রশের উত্তর লেখার আগে গল্পটা পড়ো, এই অধ্যায় থেকে প্রশ্নগুলো দিয়েছে এই অধ্যায়টা পড়ো, তাহলে নিজেরাই খুঁজে উত্তর লিখতে পারবে, তারপর লিখতে গিয়ে অসুবিধা হলে আমরা দেখিয়ে দেবো। ওদের তখন একটাই বায়না, তোমাকে পড়াতে হবে না, তুমি খুঁজে খুঁজে দেখিয়ে দাও কোথা থেকে কতটা লিখতে হবে, আমরা দেখে দেখে লিখে নেবো। পড়তে গেলে দেরী হয়ে যাবে, কাল-পরশুই জমা দিতে হবে।’ 

    একে তো কোনও বিষয়ের কোনও চ্যাপ্টার ঠিক মতো পড়া নেই, তার সাথে বাংলাটাও ঠিক করে পড়তে পারে না অনেকেই- তারা এইসব প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান করবে কীভাবে! 

    যাই হোক আজকে, বাংলা রিডিং পড়ানো অভ্যাস করাবার আগে, কেন ওদের এই রিডিং পড়া প্র্যাকটিস করা জরুরী বা বাংলা ভাষাটাকে ভালোভাবে শেখাটা জরুরী, সেটা আগে বোঝাালাম। যে, আমরা যদি ঠিক মতো রিডিং না পড়তে পারি, বাংলাটা ঠিক মতো না জানি, তাহলে কোনও বিষয়ই ঠিক মতো বুঝতে পারবো না। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান যাই পড়ি না কেন, কিচ্ছু বুঝতে পারবো না, কেননা সেগুলো পড়ে বোঝার মাধ্যম হিসেবে আমরা বাংলা ভাষাটাই ব্যাবহার করি। এই বিষয়গুলোর বইগুলো তো বাংলাতেই লেখা, তাই আমাদের বাংলা পড়তে পারাটা ভালো করে শিখতে হবে, রপ্ত করতে হবে। যাই হোক ওরা ওদের মতো করে বুঝলো, তারপর একসাথে রিডিং পড়া শুরু করলাম। ক্লাস ফাইভের দুটো পাঠ্য বই ছিলো – যেখানে এই, এতোয়া মুন্ডার কাহিনী গদ্যটা আছে। দুটো বই দিয়েই কাজ চালাতে হলো। গোল করে বসে দুটো বই দু জায়গায় রাখা হলো, মোটামুটি কয়েকজন যাতে দেখতে পারে। একজন একজন করে রিডিং পড়া শুরু করলো। একজন পড়বে বাকিরা শুনবে বা অন্য আরেকটা বইতে মেলাবে। কেউ একটা গোটা প্যারাগ্রাফ পড়ে ফেললো, তারপরেও সে আরও পড়তে চায়, কিন্তু উপায় নেই, তাকে থামিয়ে আরেকজনকে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো, কেউ পাঁচ-ছয় লাইন পড়লো, কেউ কেউ দুটো লাইন পড়েই হাফিয়ে গেল। এই রিডিং পড়া যখন চলছিল, তখন সবাই যে শান্ত হয়ে বসে শুনছিলো তা নয়, তাদের অনেকেই তাদের দুষ্টুমি, পেনসিল দিয়ে পাশের জনকে খোঁচা দেওয়া, আমার অন্যদিকে তাকিয়ে থাকা বা পড়ানোয় ব্যাস্ত থাকার সুযোগ নিয়ে একে অপরকে মাথায় চাঁটি মারা, এ ওর চুল ধরে টানা, নিজেদের মধ্যে কথা বলা, পড়ার মাঝে হঠাৎ উঠে চলে যাওয়া- এগুলোও ওরা করে যাচ্ছিল। এইসব সামলিয়েই পড়ানো চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে এতই ডিস্টার্ব করছিলো, মনে হচ্ছিল এখানেই আজকে থামিয়ে রেখে পালাই। শেষ পর্যন্ত আট জনকে দিয়েই এক পাতা পুরোটা রিডিং পড়ানো হলো। ঐ পাতা শেষ হয়ে গেলে আবার ঐ পাতারই প্রথম থেকে রিডিং পড়া বাকি তিনজনকে পড়ানো হলো। তারপর আমি নিজেই ঐ পাতাটাই দাঁড়ি, কমা মেনে, জিজ্ঞাসা চিহ্নের সুরে বা ঢঙে পড়ে শোনালাম। বললাম, দ্যাখ্ এইভাবে রিডিং পড়তে হয়, তোদেরকেও এইভাবে পড়াটা শিখতে হবে। ওরা যখন রিডিং পড়ছিল, পড়তে গিয়ে যেখানে যেখানে আটকিয়ে যাচ্ছিল বা ভুল পড়ছিলো সেইখানে ভুল শুধরে দিচ্ছিলাম, বানান করতে সাহায্য করছিলাম, বাকিরা কেউ শুনছিলো, কেউ শুনছিলো না। এইভাবে বইটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পড়া শেষ হলো, আমি রিডিং করে শোনালাম। তারপর উলগুলান, হুল কী, সেটা বললাম। সাঁওতাল, মুন্ডা বিদ্রোহের আংশিক ইতিহাস, গল্পের ছলে শোনালাম। এরা রিডিং ঠিক মতো না পড়তে পারলেও, দেখলাম এরা সকলেই অ, আ, ক, খ- র বর্ণমালার বর্ণগুলো মোটামুটি চেনে। তাই পড়তে গিয়ে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। রোজ যদি পড়াটা অভ্যাস করে, কারও একজনের তত্ত্বাবধানে, তাহলে এরা বাংলা পড়াটা আয়ত্ত করতে পারবে।

     এইবার ওদেরকে বললাম, এই যে তোরা এতোয়া মুন্ডার কাহিনী-র প্রথম পাতাটা পড়লি – এইখানে পড়তে গিয়ে তো অনেকগুলো যুক্তাক্ষর পেয়েছিস? ওরা বললো হ্যাঁ। এরই মধ্যে যারা জানতো না, তারা জেনে গেছে দুটো বর্ণ যেখানে জড়াজড়ি করে আছে, সেগুলোকেই যুক্তাক্ষর বলে। ওদেরকে বললাম, তোরা ঐ পাতা থেকে একটা করে যুক্তাক্ষর খুঁজে আমাকে বলবি, তারপর আমি সেটা বোর্ডে লিখে ভেঙে দেখাবো বা তোরাই বলবি কোন্ কোন্ বর্ণ জড়াজড়ি করে আছে। ওরা একে একে খুঁজে খুঁজে বললো, আমি বোর্ডে লিখলাম।

     

    কেউ বললো যুদ্ধ – ভেঙে দেখালাম- য+উ+দ্+ধ। কেউ বললো- মুন্ডা। ওদেরই মধ্যে এই যুক্তাক্ষর ভেঙে ভেঙে বললো কী কী আছে। এরকম করে করে ডজন খানেক শব্দ নিয়ে আমরা ভাঙাভাঙি করলাম। ওদের উলুগুলান শব্দটা বোধ হয় মনে ধরেছিল বা ভাল্ লেগেছে, দাবী উঠলো, স্যার উলগুলান লিখুন, আমরা কী কী আছে উতে লিখে দিচ্ছি। যদিও শব্দটা যুক্তাক্ষর নয়, তবে আ-কার, হ্রস্ব-ই কার যোগে কীভাবে শব্দটা তৈরী হয়েছে, সেটাকে ভেঙে দেখানোই যায়। ওরা সেটাই করলো।

     

    তারপর ওদের আরও কয়েকটা এরকম সহজ শব্দ দিলাম ওরা ব্যাঞ্জন ধ্বনি থেকে স্বর ধ্বনির চিহ্নগুলো অর্থাৎ া-কার মানে আ ধ্বনি, ী-কার মানে ঈ ধ্বনি এগুলো আলাদা করে দেখালো। ওদেরকে বাড়িতে এই শব্দগুলো নিয়ে আরেকবার নাড়াচাড়া করে দেখতে বললাম। পরেদিন আবার এই শব্দ গুলোই বোর্ডে লিখে ভেঙে ভেঙে দেখাতে হবে বললাম। এইভাবে আমাদের আজকে বাংলা রিডিং পড়ার ক্লাস শেষ হলো। অনেক্ষণ ধরে এই পড়া, লেখা, বকাঝকা করায় একঘেয়েমি লাগছিল। তাই ছুটি দেওয়ার আগে সবাই মিলে একটা গান শিখলাম, গান গাইলাম। আমার গানের গলা ভালো না, গান আমি গাইতে পারি না তবুও অন্তরা রায় চৌধুরির ‘এক যে ছিল দুষ্টু ছেলে, সারাটা দিন সে বেড়াতো খেলে…’- এই গানটার প্রথম কলিটা আমরা সুর ছাড়া প্রথমে আমি বললাম, আমাকে অনুসরণ করে ওরা বললো, তারপর একসাথে সুর দিয়ে গাইলাম। তারপর ছুটি হলো । হৈ হৈ করে, আনন্দের সঙ্গে যে যার বাড়ি চলে গেলো।

     আমি বলতে চাইছি, আমরা যারা সংহতি ইস্কুলে পড়াচ্ছি, বাচ্চাদের পড়াত গিয়ে যে যে সমস্যাগুলো দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো আমার মতো এতো ডিটেইলসে লিখতে বলছি না। শুধু সমস্যা বা ত্রুটিগুলোকে চিহ্নিত করা এবং তার কী সমাধান করা যায়, কীভাবে শেখানো যায় সেইসব সূত্রগুলো যদি নিজেরাই একটু মাথা খাটিয়ে বার করতে পারি, মোকাবিলা করতে পারি, তাহলে অন্য কারও দ্বারস্থ হতে হয় না। নিজেরাই নিজেদের এইসব বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে পারি। সেটা শুধু বাংলা নয়, অংক, ইংরেজী, বিজ্ঞান যে কোনো বিষয়ে যা যা সমস্যা হচ্ছে সেগুলো পয়েন্ট করে লিখে ফেলতে পারো। শুধু এটুকুই লেখা যাক সমস্যাটা কী আর তার সমাধান কী হতে পারে। ব্যাস।

     

     কীভাবে বাচ্চাদের বাংলা ভাষাটা শেখাতে পারবো? রিডিংটা ঠিক মতো যাতে পড়তে পারে সেটা কীভাবে শেখাবো? বানান সচেতনতার বিষয়ে কীভাবে শিক্ষা দেবো।? কমা, দাঁড়ির ব্যবহার কীভাবে শেখাবো? বর্ণ কীভাবে চেনাবো? শব্দ গঠন করা, কীভাবে শেখাবো? বাক্য গঠন করতে কীভাবে শেখাবো? পড়তে গিয়ে আ- কার হ্রস্ব-ই কারে গন্ডগোল পাকাচ্ছে, য় যেখানে সেখানে ই আর ই যেখানে সেখানে য় উচ্চারণ করছে-তাদেরকে কীভাবে বোঝাবো? 

    এইগুলো যাদের প্রশ্ন। যারা আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। কীভাবে কী করলে সহজে ভাষাটা শেখানো যায়, (এখানে আপাতত আমাদের বাংলা ভাষাটা শেখার ওপরই আমরা জোর দিচ্ছি) গড় গড় করে বাচ্চারা রিডিং পড়ে শুধু একটা বাক্য নয়, গোটা গদ্যটাই যাতে নিজে বুঝতে পারে। সেইরকম একটা শেখানোর সহজ উপায় তো আমরা চাইছি।

     

    আমি বলতে চাই, আমরা নিজেরা মাথা খাটিয়ে সহজ সরল পদ্ধতি, উপায় খোঁজার পাশাপাশি 

    সরকারি ইস্কুলের পাঠ্য বইগুলো যদি আমরা টীচাররা ভালোভাবে পড়ি, নিজেরাই একটু শিখি। পাঠ্য বইয়ের গল্প-কবিতা পড়ার কথা বলছি না। বাংলা পাঠ্য বইগুলোর প্রতিটি গল্প, কবিতার পরে সেই গল্প বা কবিতাটির ওপর অনুশীলন করার জন্য নানান ধরনের কৌশল, প্রশ্ন দেওয়া থাকে। সেগুলোকে আমরা টীচাররা নিজেরা আগে অনুধাবন করে যদি একরকম শিখতে পারি তাহলে বাচ্চাদেরকেও এইসব পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনীতে থাকা Activities গুলো করিয়ে বাচ্চাদের বাংলা ভাষা চর্চায় সাহায্য করতে পারি।

    যেমন- 

     

    এরকম অনেক আছে। খুঁজে নিতে হবে। বাচ্চাদের ওদের পাঠ্য বই ধরেই এই কাজগুলো করিয়ে ওদের ভাষা শিক্ষায় উন্নতি ঘটানো যেতে পারে। সরকারি ইস্কুলের পাঠ্যবই-এর সিলেবাস, তার কিছু গল্প, কবিতা, শেখানোর কৌশল, পদ্ধতি- খুব একটা খারাপ নয়। সেগুলো থেকে আমরা শিক্ষা নিতেই পারি। সরকারি স্কুলের টীচাররা বেশীরভাগই এইসব বই Follow করেন না। এসব পড়াতে গেলে, বোঝাতে গেলে অনেক কষ্ট! তাই তো শহরের বস্তি অঞ্চলের গরীব ঘরের বাচ্চাদের এই অবস্থা! 

    বইগুলোর PDF পাওয়া যাচ্ছে। সহজেই গুগল থেকে Download করে নেওয়া যায়। এখানে একটা link দিলাম https://www.studentscaring.com/west-bengal-board-class-5-book-pdf/

    অনেক বাচ্চারা এমনকি নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে এমন বাচ্চারাও দেখেছি। বাংলা পড়তে এবং লিখতে গিয়ে যে শব্দের বানানে য় আছে সেখানে ই পড়ছে বা লিখছে আবার যেখানে ই আছে সেখানে য় লিখছে বা পড়ছে মানে তার উল্টোটা করছে। যেমন – চায় বললে চাই লিখবে বা পড়বে। “আমি খাই” না লিখে, লিখে ফেলছে ‘আমি খায়’। আবার “সে খায়” না লিখে লিখছে ‘সে খাই’। 

    আসলে সমস্যাটা কী? 

     

    এই সমস্যা যেসব শিক্ষার্থীদের, তাদেরকে এই পুরুষ বোঝানোর পাশাপাশি কিছু সমস্যার সমাধান করতে দিতে হবে। যেমন- 

    • শূন্যস্থানে সঠিক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করো।

    [ যাই, খাই, যায়, খায়, যাও, নাও, পায়, পাই, দিও]

     

    আমি রোজ সকালে মাঠে_____। আমার সাথে সুজয় আর মালাও______। এক ঘন্টা পর মাঠ থেকে ফিরে এসে আমরা জল খাবার______। আমি সকালে জিলিপি দিয়ে রুটি_____। মালা সকালবেলা দুধ-রুটি____। সুজয়____ চা-বিস্কুট। 

    খেতে খেতে সুজয় বললো আমি কালকে দোকানদারকে টাকা দিতে ভুলে গেছি। দোকানদার আমার কাছে কুড়ি টাকা____। সুজয়ের এক জায়গায় যাওয়ার তাড়া আছে, দোকানে ভিড় দেখে মালাকে বললো, তুমি এই টাকাটা___, দোকানদারকে দিয়ে___।

     

    এরকমই কিছু।

     

    এছাড়া পাঠ্য বইগুলোর পিছনে সরকারি ইস্কুলের শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে এক কি দুপাতার শিখন পরামর্শ দেওয়া থাকে, সেগুলোও আমরা পড়ে দেখতে পারি।

    তাছাড়া, একজন শিক্ষক  হিসেবে অনুসন্ধিৎসু, খোঁজকারী হতে হবে। শিক্ষার্থীকে শেখানোর জন্য সহজ-সরল পদ্ধতি বা উপায় কী আছে তার খোঁজ করতে হবে। শেখাবার আগ্রহ থাকলে আমরা যে কোনো সমস্যা সমাধানের সঠিক পন্থা ঠিক খুঁজে বার করতে পারবো। এখন মোবাইলের যুগ, প্রায় সবার কাছেই স্মার্ট ফোন আছে, সেটাকে আমরা নানানভাবে  কাজে লাগাতে পারি। কোনো বাচ্চাকে গুন, ভাগ শেখাতে অসুবিধে হচ্ছে বা ইংরেজীর গ্রামারের কোনো সমস্যা বোঝানো যাচ্ছে না, তার জন্য আমরা  youtube- এ ছড়িয়ে থাকা অনেক ভালো ভালো, tutorial vedio আছে সেগুলো থেকে আইডিয়া নিতে পারি, সেখান থেকে শিখে তারপর বাচ্চাকে শেখাতে পারি। তবে এ বিষয়ে ভুলভাল ভিডিও থেকে সতর্ক থাকতে হবে, নিজেকে যুক্তি দিয়ে বুঝতে হবে সেটা বাচ্চাকে শেখানোর জন্য ঠিক বা কার্করী কিনা! মাথায় রাখতে হবে কোনো বাচ্চাকে কোনো বিষয়ে পড়াতে গিয়ে যদি দেখি, বাচ্চাটা বুঝতে পারছে না, তার মানে এই নয় যে বাচ্চাটার অসুবিধে, আসলে আমরাই ঠিক মতো বোঝাতে পারছি না। আমরা শেখাতে গিয়ে ব্যর্থ। আমরা যে পদ্ধতিতে, যেভাবে বোঝাচ্ছি, বাচ্চাটা সেইভাবে বুঝতে পারছে না, অন্যভাবে বোঝালে হয়তো বুঝবে।

    তার মতো করে বোঝানোর জন্য আমাদেরকেও তার মতো করে ভাবতে হবে। শিশুকে শেখাবার সময় শিশুর চিন্তা-ভাবনার উপযোগী স্তরে দাঁড়িয়ে ভাবতে হবে, শেখাতে হবে। ওরা তো আমাদের, বড়োদের সবসময় ভাবে বা চিন্তা করে না! তাই শিশুসুলভ Activies, Game, Movie, Story-র মাধ্যমে শিশুর কাছে পৌঁছাতে হবে। পড়াশোনা ওদের কাছে আনন্দের করে তুলতে হবে। তাহলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক হবে। 

     যাই হোক আমার এই পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি, পরামর্শ, পড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে যা কিছু লিখেছি, পুরোটা পড়ে তোমাদের প্রতিক্রিয়া জানিও। 

     

  • পরীক্ষা, ই-মেইল ও ইত্যাদি

     

    দুটো ব্যাপারকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে ও হচ্ছে ক্রমাগত। প্রথমত, একটা গোটা দিনেরও কিছু কম সময়ের নোটিশে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নির্ধারণে গণভোটের বন্দোবস্ত,  যেটা নিছক প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। সময়টা আরো অনেকটা বেশি দিলে কিছু প্রয়োজনীয় মতামত হয়তো উঠে আসতে পারত। তারপরেও কথা হল, কার্যকরী  ই-মেইল মারফত মতামত জানাতে সক্ষম জনসাধারণের সংখ্যাও নিতান্ত কম এ রাজ্যে। অতএব সরকারের এই ব্যবস্থাপত্রটি হয় চূড়ান্ত অবিবেচনাপ্রসূত, আর নয় তো স্রেফ এক ধোকার টাটি। পরীক্ষা না নেবার সিদ্ধান্ত হয়তো আগেই গৃহীত ছিল। নইলে প্রায় দেড়টা মাস জুড়ে রমরম করে নজিরবিহীন ভোটরঙ্গ উদযাপিত হল  অথচ মার্চ-এপ্রিলে পরীক্ষা নেওয়া গেল না–এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ডের কোনো ব্যাখ্যাই মেলে না।  হাজার দেড়েক মন্ত্রী এমএলএর ভাতা মুলতবির চাইতে প্রায় ষোলো সতের লাখ ছাত্রের পরীক্ষা বন্ধের কাজটাই তুলনামূলক লঘু আর শস্তা মনে হল সব সরকারের?  কিন্তু তারপরেই এসে পড়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন আর সেটা আরও মৌলিক : এবারের মতো পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া কি উচিত হল? নাকি হানিকর হল ছাত্রসমাজের পক্ষে?

    এই দ্বিতীয় প্রেক্ষিতে স্পষ্টত দুভাগ বুদ্ধিজীবী বিদ্বৎসমাজ। প্রচলিত চিন্তার পক্ষের, সরাসরি দক্ষিণপন্থী এবং মূলস্রোতের বাম সমর্থকদের মতে পরীক্ষা বন্ধটা যেকোনো পরিস্থিতিতেই এক মহা দুর্যোগ। এঁদের মধ্যে একটা বড় অংশের মানুষ খুব স্বাভাবিক কারণেই পাশ ফেল প্রথা বজায় রাখারও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। পরীক্ষাব্যবস্থা তাঁদের কাছে এক অপরিহার্য শুচিতার প্রতীক। পরীক্ষার কলে পেষাই না হলে ছেলেমেয়েরা সঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না–এমনটাই এঁদের অভিমত। এঁদের সঙ্গে দ্বিমত হতে অসুবিধা হয় না।

    কিন্তু, আমাদের মতো যাঁরা জানেন যে পরীক্ষার সাথে মূল বিষয়শিক্ষা, জীবনের অর্জন বা সৃষ্টিশীলতার কোনো সরাসরি সম্বন্ধ নেই, তাঁদেরও সামান্য গলতি হয়ে যাচ্ছে বর্তমান পটভূমির তুল্যমূল্য বিচারে। সত্যিই তো এটা ঠিক যে পরীক্ষার জাঁতায় শুধু প্রাণশক্তিই নিংড়ে যায়, প্রকৃত শিক্ষার সুযোগ তাতে অতি সামান্যই। কিন্তু মুসকিল হল এই যে সে কথাটা আজ এই দুহাজার একুশের মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের চরম সময়টিতে খেয়াল পড়লে চলবে কী করে? সেই ছাত্রছাত্রীরা কি পরীক্ষামুক্ত নির্ভেজাল সেই শিক্ষার জন্য প্রস্তুত? আমরা কি পিছনের কয় বছর ধরে প্রস্তুত করে তুলতে পেরেছি তাদের? চেষ্টা করেছি? তারা তো গতানুগতিক পথেই জেনেবুঝে এসেছে এতদিন। আজ হঠাৎ তাদের সামনে থেকে পরীক্ষা নামক এই তথাকথিত গন্তব্যটি মুছে ফেললে কী করে চলবে? প্রথমত তো এতে তাদের মধ্যে একটা আকস্মিক উদ্দেশ্যহীনতা জন্মাতে পারে, সিঁড়ির শেষ ধাপের জন্য পা বাড়িয়েও সিঁড়ি না পেলে যেমন হয়। তার মানসিক প্রভাব যথেষ্ট। আর দ্বিতীয়ত, পরবর্তী শিক্ষাজগতে প্রবেশের যে কায়দা-কানুন, তাতে তো এই দুই পরীক্ষার ফলাফলের গুরুত্ব আছে। সেটাকে পাশ কাটিয়ে কীভাবে এই পদ্ধতির অংশীদারত্ব শুরু করা যাবে সেটা পরিস্কার নয়। যে কোনো কলেজে ভর্তির জন্য উচ্চমাধ্যমিকের প্রাপ্ত নম্বর দ্যাখা হয়। কোনো টেস্ট বা ওইজাতীয় পরীক্ষাও নেওয়া যায়নি। কলেজগুলো কী ভিত্তিতে ভর্তি নেবে তবে এখন? অনেকে নির্দিষ্ট বিষয়ে ভর্তির জন্য সেই বিষয়ের পরীক্ষা নেবার কথা বলছেন। কিন্তু সে পরীক্ষাও তো অফলাইন হবার সম্ভাবনা কম। তবে স্মার্ট ফোন/কম্প্যুটার/ইন্টারনেট বঞ্চিত বৃহত্তর ছাত্রসমাজ কীভাবে সেইসব পরীক্ষা দেবে? বিভিন্ন রাজ্য স্তরের পরীক্ষা দেবার জন্যেও দরকার হয় এই দুই পরীক্ষার মূল্যায়ন। তারই বা কী নিরসন?

    প্রশ্ন উঠছে যে প্রায় দুখানা শিক্ষাবর্ষ জুড়ে কোনো কার্যকরী ক্লাস না হওয়া শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হবে কীসের ভিত্তিতে? প্রথম কথা হল, ক্লাস না নেওয়াটাও কিন্তু সরকারি গাফিলতিরই প্রকাশ।   কীভাবে এই লকডাউন পরিস্থিতিতেও পাঠদান চলতে পারত সে বিষয়ে কোনো মতামত বিনিময়ের উদ্যোগ দেখা যায়নি সরকারি তরফে। সুতরাং, তাঁদের অপদার্থতার কুপ্রভাব অনায়াসেই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ওপর পড়তে দেওয়া সঠিক হবে কি? মাধ্যমিক না হলে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষার্থীর পছন্দ বা দক্ষতার কোনো পরিচয় পাওয়া যাবে না। ফলত, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিভিন্ন বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অসুবিধার সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে হয়। আবার উচ্চমাধ্যমিকে বিভিন্ন বিষয়ের মূল্যায়নের অনুপস্থিতি কলেজগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে।

    অতএব, এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য এই যে পরীক্ষাব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতা, পরীক্ষার সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্কহীনতা–বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় আনা দরকার। এবং শিক্ষাব্যবস্থা নতুন করে ঢেলে সাজার সদিচ্ছা ও সেই বাবদে দাবি-দাওয়ার আন্দোলন অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু  হঠাৎ এক ২০২১ এর জুনে বসে এক বছরের পরীক্ষার্থীদের নমুনা হিসেবে নিয়ে সে ব্যাপারে কোনো আমূল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়াটা ভুলই হবে, অন্যায্য হবে।

    এবারে, যদি ধরে নিই এবছর মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া যেত এবং নিলে ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে কোনো না কোনো অর্থে ভালোই হত, তখন আমরা আলোচনার পরবর্তী অংশে গিয়ে ঢুকতে পারি। সেটা হল কীভাবে নেওয়া যেতে পারত এই দুই পরীক্ষা। প্রথমেই, কোনোরকম অনলাইন পরীক্ষা বা উত্তর লিখে আপলোড করা ইত্যাদি সবরকম সম্ভাবনার উত্তরেই একটা স্পষ্ট ‘না’ জানিয়ে রাখতে হয়। যে রাজ্যে ৭০% লোকের ভালো মোবাইল নেই, অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেটের সংযোগ নেই বা থাকলেও খুব দুর্বল, সেখানে এই পদ্ধতি যে সবচাইতে বড়  বৈষম্যের কারণ হবে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং, প্রথমেই নাকচ করে দেওয়া দরকার অনলাইন পরীক্ষা সংক্রান্ত  যেকোনো চিন্তাভাবনা। পরীক্ষা নেওয়া গেলে–যদি আদৌ নেওয়া যেত–তাকে হতে হত সম্পূর্ণ অফলাইন। সেক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের নিজের নিজের স্কুলে পরীক্ষা হবার যে প্রস্তাব উঠেছিল সেটিই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। এবং মনে রাখা দরকার যে স্কুলগুলোতে গত প্রায় দেড়খানা বছর ধরে পড়াশুনা কিছুই হয়নি বলা চলে। অতএব পরীক্ষা হলে তার প্রশ্নের পূর্ণ মান হওয়া উচিত ছিল অন্তত অর্ধেক (অর্থাৎ ৯০ এর অর্ধেক বা ৪৫), সমস্ত প্রশ্ন হওয়া উচিত ছিল অব্জেক্টিভ ধরনের, এবং পুরো বই থেকে পরীক্ষা না নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু অধ্যায় আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল যেখান থেকে প্রশ্ন হবে। এবং এই গোটা কাজটাই সম্পন্ন হওয়া দরকার ছিল পরীক্ষার দিন ঘোষণার সময়েই, যে সময়টা আবার বাছা উচিত ছিল পরীক্ষার সময় থেকে অন্তত মাস দুই আগের কোনো দিনে। এই সঙ্গে আরেকটা কাজও করে দেখা যেত বলে মনে হয়।  নেট সেট-এর মতো জাতীয় বা রাজ্য স্তরের পরীক্ষাগুলোর অনুসরণে বিভিন্ন বিষয়ের একসঙ্গে প্রশ্নপত্র করার ব্যবস্থা করতে পারলে পরীক্ষার দিন, প্রশ্ন ছাপানোর হ্যাপা সবেতেই খানিক কম করা যেতে পারত। অর্থাৎ, ধরা যাক একদিনের প্রশ্নে(মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে) বাংলা-ইংরাজি-ইতিহাস-ভূগোল বিষয়সংক্রান্ত প্রশ্ন থাকল: সবই অব্জেক্টিভ। আবার দ্বিতীয় দিন অঙ্ক-ভৌত বিজ্ঞান-জীবন বিজ্ঞানের প্রশ্ন হল এক প্রশ্নপত্রে। এতে করে দুদিনের মধ্যে গোটা পরীক্ষা প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত করে ফেলা যেত। পরীক্ষা গ্রহণের একাধিক স্লট করার ব্যবস্থাও অনেক ছাত্রছাত্রীর একজায়গায় সম্ভাব্য সমাগম কিছুটা কমিয়ে ভিড় থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা কম করত।

    কিন্তু এসবকিছুই বিভিন্ন মতামত আকারে উঠে আসা সম্ভব ছিল বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের বা এমনকি জনসাধারণের থেকেও, যদি সরকার সত্যিকারের সদিচ্ছা নিয়ে মতামত গ্রহণের পদ্ধতিটা চালাতে চাইতেন। তার জন্য মতামত নেবার পরিসর ও সময় দুটোই অনেকটা বাড়াতে হত অবশ্যই। বাস্তবত তাঁরা তা চাননি। আর আমরাও পরীক্ষা হলে ভালো নাকি নাহলে খারাপ–এই ব্যাসকূট তর্কে মজে এই মুহূর্তের সংকট মোচনের মতো কোনো আপাত তাৎক্ষণিক সমাধানসূত্র বার করার দিকে নজর দিচ্ছি না। যদিও তাতেও আর কিছু লাভ-লোকসান বৃদ্ধি নেই। সিদ্ধান্ত তো নেওয়াই হয়ে গিয়েছে।

    শেষ করার আগে এবার বক্তব্যের সবচেয়ে ছোটো কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশের অবতারণা করতে হবে। এই মুহূর্তে সবটুকু মনোযোগই নিবিষ্ট হচ্ছে পরীক্ষা হওয়া না হওয়ার প্রতি। কিন্তু শিক্ষা? পাঠদান? সবার আগে তো তারই জায়গা হবার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে কি? মাসের পর মাস সরকারি স্কুলগুলো বন্ধ এবং অনলাইন ক্লাস বলতে যা হচ্ছে এবং যে নগন্য সংখ্যক ছাত্রছাত্রী তাতে অংশ নিতে পারছে তাতে শিক্ষা এক ইঞ্চিও এগোয় না এ একেবারে নিশ্চিত। পুনরাবৃত্তি হলেও বলতেই হচ্ছে সরকারি স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, জোরদার ইন্টারনেট কানেকশন, এবং আনলিমিটেড ডেটা কভারেজের সুযোগবঞ্চিত। ফলে কোনোভাবেই (ট্যাব কিনবার টাকা দিলেও) অনলাইন শিক্ষাদানে আমাদের রাজ্যের (বা দেশের) মূল ধারার শিক্ষার্থীদের অংশীদার করা অসম্ভব। তাহলে কি কিছুই করা যেত না ( বা যায় না এখনো?)? এলাকাভিত্তিক স্কুল ও তার শিক্ষকদের বাড়ির ঠিকানা সরকারের ঘরে মজুত আছে। ফলে যে শিক্ষক যে অঞ্চলে থাকেন তাঁকে সেই অঞ্চলের স্কুলের শিক্ষার্থীদের তাঁর  নিজের বিষয় পড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারত। তার সাথেই টেলিভিশনে, এমনকি স্থানীয় কেবল চ্যানেলে স্থানীয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহায়তায় সম্প্রচারের মাধ্যমে মোটামুটি নিয়মিত পাঠদান পদ্ধতি চালু করা যেত। ইন্টারনেট না থাকলেও এলাকায় ক্লাব ইত্যাদিতে একটা টেলিভিশন প্রায় বেশিরভাগ জায়গাতেই পৌঁছে গেছে এখন। এই উপায় এখনো কেন যথাযথ কাজে লাগানো হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দরকার। এমন আরো অনেক উপায় নিশ্চই আছে। সেগুলো খুঁজে বের করে বাস্তবায়িত করার সদিচ্ছার প্রয়োজন।

    সবশেষে আবারও বলি, পরীক্ষাব্যবস্থা বা আরো বড় করে বললে আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই পচন-ধরা, ত্রুটিপূর্ণ, প্রকৃত শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্করহিত। এ বিষয়ে কোনো সংশয়ের জায়গাই নেই। কিন্তু সে বাবদে কোনো অর্থপূর্ণ দাবি-দাওয়া, আলোড়ন, আন্দোলন ইত্যাদি ছাড়াই হঠাৎ করে আজ করোনার প্রাদুর্ভাবকে উপলক্ষ্য করে দুটো তথাকথিত গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্ত সেবছরের অপেক্ষমান ছাত্রছাত্রীদের ওপর কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে না বলেই আমার মনে হয়।  কারণ, তার জন্য পরীক্ষাদুটোর পরবর্তী যে শিক্ষাজীবন, সেখানে পরিকল্পিত কিছু বন্দোবস্ত থাকা জরুরী ছিল। সে ব্যবস্থা ব্যতিরেকে ছাত্রছাত্রীরা–অন্তত যারা এর পরেও পড়তে চাইবে বা পারবে–তারা সে পথে এগোবে কী উপায়ে? আর যারা আর এগোবেও না, তাদের কাছেও এই পরীক্ষাগুলোর ফলাফল–তা সে যেমনই হোক–সম্পূর্ণ মানেহীন হবে না। হবে যে না, সেটা এই পরীক্ষাব্যবস্থার সাফল্য নয়, আমাদের এতদিনকার অভ্যস্ততার পরিণতি।কাজেই সেটা অন্তঃসারে অশুভ হলেও এই মুহূর্তে রাবার দিয়ে মুছে ফেলার মতো করে নাকচ করা যাবে না তাকে।  এখনকার মতো এ সংকট থেকে মুক্তির উপায় দরকার ছিল। তারপর সবাই মিলেই নামা যেত (বা এখনো যায়) গতানুগতিক পরীক্ষা (ও শিক্ষা) ব্যবস্থাবিরোধী আন্দোলনে। সে পথ থেকে সরে আসার প্রশ্নই ওঠে না।

    সিদ্ধার্থ বসু

    ১১ জুন ২০২১

    Original Source: https://edeshaamar.com/exam-email-etc/

     

  • এ যে কত বড় ক্ষতি.. শুধু পাঠ্য বিষয় না-শেখা নয়, মানুষ হওয়ার পথও আটকে যাচ্ছে

     

    “ওরা ভাল নেই।” গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে যত বার প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তত বারই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথাটা শুনতে হয়েছে। এক জন-দু’জন নয়, অনেকের কাছ থেকে। কাজের সূত্রে বহু প্রাথমিক শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়। ‘ওরা’ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু। মাস্টারমশাইদের কথার সারসংক্ষেপ: স্কুল বন্ধ বলেই ওরা ভাল নেই। বিক্ষিপ্ত ভাবে নানা জনে নানা চেষ্টা করছেন, যাতে স্কুল বন্ধ থাকা অবস্থায় লেখাপড়ার সঙ্গে বাচ্চাদের সংযোগটা বজায় রাখা যায়। খবর আসে, পাঠ দানের ছোট ছোট ভিডিয়ো, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সাহায্যে যোগাযোগ, ফোনে কথা, মা-বাবাদের পাঠ্য বিষয় বুঝিয়ে দেওয়া, বাড়িতে কাজ করার জন্য ওয়ার্কশিট বানিয়ে পাঠানো ইত্যাদি নানা পদ্ধতিতে শিশুপাঠ জারি রাখার। “যত যা-ই করুন, এগুলো সিন্ধুতে বিন্দু। ক’জনের স্মার্টফোন আছে? ক’জনই বা ইন্টারনেটের সুবিধা পায়?” এখানে শিক্ষকেরা যে প্রশ্ন তুলছেন, সেটাকেই প্রমাণ করছে সম্প্রতি ইউনিসেফ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা— সারা পৃথিবীর অন্তত ৩০ শতাংশ বাচ্চার কাছে ফোন বা ইন্টারনেটের সুবিধা নেই। ভারতে এই অনুপাতটা অনেক বেশি হবে। তার উপর সমীক্ষা বলছে, বঞ্চিতদের তিন-চতুর্থাংশই গ্রামাঞ্চলের এবং দরিদ্র পরিবারের। প্রাথমিক শিক্ষকদের মঞ্চ ‘শিক্ষা আলোচনা’র সদস্য বন্ধুরা জানাচ্ছেন, শুধু গ্রামে নয়, শহরেও বহু শিশুর কাছে স্মার্টফোন জাতীয় সুবিধা স্বপ্নের ব্যাপার। ফলে একটা দুশ্চিন্তা এই যে, দীর্ঘ দিন স্কুলের সঙ্গে অ-সংযোগের কারণে বাচ্চাদের অনেকেই স্কুলছুট হয়ে যাবে। পৃথিবীর অভিজ্ঞতাও তাই বলে। ইবোলা মহামারির কারণে সাত মাস স্কুল বন্ধ ছিল লাইবেরিয়ায়, স্কুলছুট হয়েছিল ২৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আমাদের দেশে অনুপাতটা অনেক বেশি হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা মনে করছে, ২০০০ সালের পর বিশ্বে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে কমে যাওয়া শিশুশ্রমের হার (৯৪ শতাংশ) আবার উল্টো পথ নিতে পারে। অচিরেই বিশ্বে এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে বহু শিশুকে সস্তা মজুরের বাজারে দেখতে পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে দুঃস্বপ্নের মতো নেমে আসছে আর এক সঙ্কট। একটা গোটা প্রজন্ম পাঠের অন্তর্গত বিষয়ের প্রায় কিছুই শিখতে পারবে না। আজ়িম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির করা একটি গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে যথাক্রমে ৯০ শতাংশ ও ৮২ শতাংশ শিশু ভাষা ও গণিত বিষয়ক সামর্থ্যের দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। “এমনিতেই এক-দু’সপ্তাহ কামাই হয়ে গেলে বাচ্চারা অনেক কিছু ভুলে যায়, তাদের নতুন করে শেখাতে হয়। এখানে তো মাসের পর মাস পড়ার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই। কী হবে বলুন তো? আবার অনেকে শিশু শ্রেণির বা প্রথম শ্রেণির ক্লাসে আসতেই পারেনি। তাদের অবস্থা ভাবুন।”— বলছিলেন এক শিক্ষক।

    “গোটা প্রজন্মটাই অন্ধকারে চলে গেল। এ যে কত বড় ক্ষতি, অনুমান করতেও ভয় লাগে।” তিনি যেন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছেন: “শুধু গণিত, বাংলা, ইংরেজি, পরিবেশের মতো পাঠ্য বিষয়ের ক্ষতি হলে একটা কথা ছিল। বাচ্চাদের মানুষ হয়ে ওঠার পথটাই আটকে গেল। তাদের মানসিক বিকাশের অনেকটাই ঘটে ইস্কুলে। এখন ওরা নিঃসঙ্গ। একেবারে একা।” শিক্ষাবিজ্ঞান আমাদের জানায় যে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়গত সামর্থ্য যতটা জরুরি, ততটাই জরুরি শিশুদের সামাজিক-আবেগগত শিক্ষা (সোশিয়ো-ইমোশনাল লার্নিং)। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়া, খেলতে না পারা, বাইরে বেরোতে না পারা, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ না থাকা ইত্যাদি কারণে শিশুরা বিষণ্ণতার শিকার হচ্ছে, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব পরিবারেই। বিত্তশালী বাড়ির বাচ্চারা হয়তো প্রযুক্তি, মা-বাবা, প্রাইভেট টিউশন প্রভৃতির সাহায্যে পাঠ্য বিষয় শিখে উঠতে পারছে, এবং প্রতিযোগিতার বাজারে তাদের দরিদ্র সহপাঠীদের থেকে হাজার হাজার মাইল এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ হওয়ার প্রক্রিয়ায় বঞ্চিত হচ্ছে তারাও। তাদের মধ্যেও বেড়ে উঠছে ফোন বা ইন্টারনেটকে সঙ্গী করে, ঘরের মধ্যেই এক বিচ্ছিন্ন বিশ্বে নিজেকে বন্দি করে রাখার ঝোঁক। দরিদ্রের সমস্যা ঘোরতর। এক দিকে ক্ষুধা, অনাহার, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যের বিপদ, অন্য দিকে, তাদের মনের উপর নিরন্তর চাপ। সারা ক্ষণ রোগ নিয়ে কথা, মা-বাবার অনিশ্চিত রোজগার নিয়ে কথা, মৃত্যু নিয়ে কথা। তাদের জীবন এমনিতেই আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় ভরা, স্কুল তাদের সেই সব সঙ্কট থেকে খানিক মুক্তি দিত। “ইস্কুল বন্ধ হয়ে তাদের জীবনটাকেই ছারখার করে দিল। তাদের কত জনের বুদ্ধি স্বাভাবিক পথে এগোবে, বলা কঠিন। কেউ মুষড়ে পড়ছে, কেউ আরও একাকিত্বে সেঁধিয়ে যাচ্ছে, কেউ বা অপরাধের দিকে ঝুঁকছে”, বলছিলেন এক শিক্ষিকা। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি: “তাদের মধ্যে যারা ইস্কুলে ফিরতে পারবে, তাদের কত জনকে আমরা একটা সুস্থ জীবনের পথ দেখাতে পারব, আমার জানা নেই।”

    এক কথায়, দেশের কয়েক কোটি শিশুর জীবন থেকে তাদের শৈশব কেড়ে নেওয়া হল। বন্ধু, শিক্ষক, স্কুল, কলতলা, খেলার মাঠ, আকাশের রং, গাছের পাতা, পাখির ডাক, আইসক্রিম বিক্রেতার ঘণ্টি, কাগজের নৌকা, মাটির গন্ধ— সব কেড়ে নেওয়া হল। কেড়ে নেওয়া হল, কারণ সেটাই সবচেয়ে সহজ, তার জোরালো ঐতিহ্য আছে। আমরা এমন এক দেশের বাসিন্দা, যেখানে শিশুদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে জেনেও ভোট, পুলিশ ক্যাম্প, পার্টির মিটিংয়ের মতো নানা কাজে সর্বাগ্রে স্কুলটার দখল নেওয়া হয়। সেই ঐতিহ্য মেনেই, কোভিডের ত্রাহি রব শুরু হওয়ামাত্র সরকার প্রথমেই যেটা করল, তা হল স্কুল বন্ধ করে দেওয়া। শিশুদের লেখাপড়ার কী হবে, তাদের জীবনের কী হবে, এ সব ভাবনা সরকারের নীতিতে জায়গা পায়নি। আবার নাগরিক সমাজও বোধ হয় অতিমারির আতঙ্কে এতটাই বিহ্বল যে, দেশের শিশুদের কথা তার মাথায় আসেনি। তাই যদি বা কেউ প্রশ্নটা তোলার চেষ্টা করেছেন, তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগে প্রাণ বাঁচাতে হবে, তার পরে লেখাপড়া, ও সব পরে হবে।

    সামান্য তলিয়ে ভাবলে সত্যটা অন্য ভাবে ধরা দিত। লেখাপড়া ও শিশুদের জীবনের গড়নের কাজটা অতিমারি প্রতিরোধের বিরোধী নয়। এবং, মারিতে যে ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে— জীবনহানি, দুর্ভোগ, আয়ের ক্ষতি ইত্যাদি— তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হয়ে চলেছে মাসের পর মাস স্কুল বন্ধ থাকায়। শিশুরাই যদি ভাল না থাকে, দেশ কী করে ভাল থাকবে? বস্তুত, এই চিন্তা থেকেই বিশ্বের কিছু কিছু দেশে অতিমারির মধ্যে বাচ্চাদের লেখাপড়া ও গোটা জীবনকে অক্ষত রাখার জন্য নানা ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন, সুইডেন স্কুল খোলা রেখেছে, শিশুদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থেকেছে। ইউরোপের যে সব দেশ স্কুল বন্ধ রেখেছিল, তাদের মধ্যে অনেক দেশই আবার স্কুল খুলে দিয়েছে বা দিচ্ছে। কিছু দেশে স্কুল পুরো খোলা হয়নি, কিন্তু পাড়ায় গিয়ে ছোট ছোট দলে শিশুদের লেখাপড়া করানো হচ্ছে। বহু দেশে ইস্কুল বন্ধ থাকা অবস্থাতেও দৈনিক স্কুলের খাবার দেওয়া হয়েছে; আমাদের এখানে যে রকম মাসিক চাল, আলু ইত্যাদির প্যাকেট ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমন নয়। খাবার দেওয়ার প্রক্রিয়ায় বাচ্চাদের সঙ্গে খানিকটা হলেও স্কুলের যোগাযোগ বজায় রাখার চেষ্টা হচ্ছে।

    আমরা কি পারতাম না? কিছু শিক্ষক তো ছোট ছোট আকারে বাচ্চাদের স্বাভাবিক জীবন ধরে রাখার কাজে নানা উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিশুদের বাড়ির কাছে কোনও ফাঁকা জায়গায় ছোট দলে ভাগ করে, অথবা বিভিন্ন বয়সের বা শ্রেণির শিশুদের জন্য পালা করে ক্লাস চালানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ রাজ্যেও কিছু কিছু জায়গায় শিক্ষকেরা স্থানীয় শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সাহায্যে এ রকম ক্লাস চালাচ্ছেন। আবার, কোথাও স্থানীয় নেতাদের অতি সতর্কতার দাপটে উদ্যোগ শুরু করেও থেমে যেতে হয়েছে। সরকার চাইলেই শিশুদের জীবন স্বাভাবিক রাখার জন্য এই সমস্ত শিক্ষক, সমাজের অন্যান্য মানুষ ও রোগ-বিশারদদের সঙ্গে পরামর্শ করে নানা ভাবে স্কুল খোলার ব্যবস্থা করতে পারত। সেটা শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন অবদান রাখতে পারত। রোগ-বিশারদ ও জনস্বাস্থ্যবিদদের মধ্যেও জোরালো আওয়াজ উঠছে স্কুল খোলার, যার উদাহরণ— দ্য গ্রেট ব্যারিংটন ডিক্লারেশন।

    সাবধানতা মেনেই স্কুল খোলা যায়। কিন্তু সাবধানতার নামে ছোটদের জীবনের গতিটাকে রুদ্ধ করে দেওয়া চলে না। তাদের স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার জন্য কথা বলতে হবে, কথা শুনতে হবে, চিন্তা করতে হবে এবং শিশুদের জীবন নিয়ে দুশ্চিন্তাটা অনুভব করতে হবে। স্বীকার করতে হবে যে— ওরা ভাল নেই।

    কুমার রাণা
    ১১ জুন ২০২১ ০৪:৫৫
  • অনলাইন নাকি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মুখোমুখি পঠন-পাঠন? কোরোনা আবহে শিক্ষার ভবিষ্যত কী???

    • কোরোনা ভাইরাস এখনো আমাদের দেশ তথা গোটা বিশ্বকে নানান ভাবে প্রভাবিত করে চলেছে। যার মধ্যে সংখ্যালঘু গরীব সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত, ক্ষতিগ্রস্ত। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলি জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তায় চরম সংকটে ভুগছে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মতো আমফান এসে কোরোনা, লকডাউনের সাথে সুন্দরবনসহ প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলের মানুষদের জীবনকে আরও কষ্টকর করে তুলেছে। বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে, দেশের অর্থনীতিরও বেহাল অবস্থা। এমন একটা অস্থির পরিস্থিতিতে বাড়ির ছোটোরা যারা এখনো কাজের জগতে আসেনি, পড়াশোনা করছে, তাদের জীবনেও কোরোনা গভীর প্রভাব ফেলেছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ। কবে খুলবে, আদৌ এ বছর খুলবে কিনা তাই নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে। এখোনো পর্যন্ত মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ফলাফলই বেরোয়নি। কবে রেজাল্ট বেরোবে আর কবে নতুন ক্লাসে একাদশ শ্রেণীতে এইসব ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তি হবে ? রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকলেও অনেক ছাত্র-ছাত্রীই এরই মধ্যে বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে একাদশ শ্রেণীর পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে। অন্ততঃ ক্লাস ইলেভেনের বাংলা আর ইংলিশ কমন সাবজেক্ট দুটো। রেজাল্ট না বেরোনো পর্যন্ত তো আর এখনই কোনো বিভাগ বেছে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না; সায়েন্স, কমার্স নাকি আর্টস কে কোনটা নিয়ে উচ্চ শিক্ষার পড়াশোনায় ভবিষ্যতকে নিশ্চিত করবে তা এখনই নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।
      একাদশ শ্রেণীর দু’তিনটে পরীক্ষা বাকি থাকলেও, তাদের আর পরীক্ষা দিতে হচ্ছে না। তারা পাশ করে দ্বাদশ শ্রেণীর সিলেবাস নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছে। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদেরও প্রায় বলে দেওয়া হয়েছে আর পরীক্ষা দিতে হবে না, সটান কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে পারবে। ঝুঁকিহীন ভাবে অর্ধেক পরীক্ষা দিয়ে, রেজাল্টের মাধ্যমে মান নির্ণয়, যোগ্যতা নির্বাচন ছাড়াই আরামসে এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে উত্তীর্ণ হতে পেরে ফাঁকিবাজ ছাত্রছাত্রীরা তো বেজায় খুশি! একজন একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী, যদিও এখন সে দ্বাদশ শ্রেণীর, তার কথায়- “এইভাবে যদি পরীক্ষা, রেজাল্ট ছাড়াই প্রতিটা ক্লাসে পাশ করে যেতাম, তালে হেব্বি হোতো!” রেজাল্টের অপেক্ষায় থাকা একজন মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী বলছে, ” লকডাউনটা উঠে যায় যাক কিন্তু কোরোনা থাকুক, তালে আর স্কুলে টুলে যেতে হবে না। ভারী মজা!” আসলে ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থীদের এইধরনের চিন্তা ভাবনাটাই স্বাভাবিক। শিক্ষাটা যখন শুধুমাত্র জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার মতো হয় তখন সেখানে শেখার বা জানার আনন্দটাই হারিয়ে যায়। এমন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল যে শুধু কিছু তত্ত্ব এবং তথ্যকে মুখস্থ করে গিলে, সংখ্যার পিছনে ছুটে পরীক্ষার খাতায় বমি করে আসাটাই শিক্ষার মানদণ্ড বা ভবিতব্য হয়ে উঠেছে। এটাই যেন মনে হয় স্বাভাবিক। কোনো বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে গভীরভাবে জানতে বা বুঝতে ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশই নিরুৎসাহিত বোধ করে। একজন আমিষ প্রিয়কে জোর করে নিরামিষ গেলানোর মতো শিক্ষার্থীদের পাঠক্রমকে জাস্ট গিলিয়ে দেওয়া হয়। তাতে পুষ্টি তো দূরের কথা তাৎক্ষণিক তৃপ্তি বা আনন্দটুকুও মেলে না। এইভাবেই আমাদের দেশের ছাত্রছাত্রীরা অজ্ঞানতার অপুষ্টিতে ভোগে আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্যহীন ছুটে চলে। এরাই দেশের নাগরিক হয়, দেশের ভালো- মন্দ বিচার করে। তাই দেশ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসিত হলেও গণর অর্থাৎ জনগণের ভূমিকা থাকে জম্বি মানে জীবন্ত লাশের মতো। শিশুবেলা থেকে নাগরিক হয়ে ওঠা পর্যন্ত সে শুধুই কাগজই গিলেছে জ্ঞানকে আত্মস্থ করে উঠতে পারিনি। তাই বেকারত্বের সাথে লড়াই করতে করতে যা হোক একটা কাজ জুটিয়ে, বিয়ে করে, সন্তানের জন্ম দিয়ে সংসারী হয়ে নিরাপদ জীবন কাটানোর পরিকল্পনা করে। দেশের জন্য ভাবতে তার বয়েই গেছে; কর্তব্য, দায়িত্ব ঐ ভোট মেশিনের বোতাম টেপাতে, উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় ‘মেরা ভারত মহান’ বলাতে, দেশের ভালো চেয়ে সমালোচনা করা মানুষ পেটাতে আর সরকারের দালাল চ্যানেল দেখে উত্তেজিত হয়ে যুদ্ধ হোক, যুদ্ধ চাই, বলাতেই সীমাবদ্ধ। না, বিষয়ের বাইরে চলে গিয়ে বেলাইন হয়ে যাচ্ছে লেখাটা। লাইনে ফিরে আসি।
      সরকারি স্কুলগুলোতে বাস্তবসম্মত পঠনপাঠনের ব্যবস্থা নেই, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনুযায়ী যথেষ্ট শিক্ষক নেই, অধিকাংশ সরকারি স্কুলে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাবরেটরি নেই, লাইব্রেরি নেই, খেলার মাঠ নেই। ভিডিও বা সিনেমার মতো ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে শেখার ব্যবস্থা নেই। বছরে একবার অন্তত শিক্ষামূলক ভ্রমণের ব্যবস্থা নেই। শুধু বই পড়ে আর শিক্ষক-শিক্ষিকার থেকে জেনে কতটুকু জানা বা শেখা যায়? মালভূমি, পাহাড়, ঝর্ণা, মরুভূমি নিজের চোখে না দেখে বইয়ের পাতায় অস্পষ্ট ছবি আর কল্পনা দিয়ে কতটা উপলব্ধি করা যাবে? সেটা ইতিহাস হোক বা বিজ্ঞান যে কোনো বিষয়কে শিক্ষার্থীদের কাছে বাস্তবসম্মত(practicaly) মনোগ্রাহী (interesting) করে না তুলতে পারলে তাদের কাছে পড়াশোনাটা নীরস, কাঠকাঠ মনে হবে। বাবা-মা পড়তে বলছে, তাই একরকম জোর করে পড়া, নিজেদের ইচ্ছা বা মনের জোরে পড়াশোনাটা করা সকলের হয় না। আর এখন কোরোনা আবহে স্কুল বন্ধ রেখে অনলাইন পঠন পাঠন চালু হলে এই পিছিয়ে পড়া, পড়াশোনায় অনুৎসাহীদের অবস্থা আরও বেহাল হবে। একজন থার্ড ইয়ারের কলেজ ছাত্রী জানালো, এই জুলাই মাসেই তার নাকি পরীক্ষা! কিন্তু সে চিন্তিত পরীক্ষাটা আদৌ হবে কি না সেই নিয়ে। সে সংশয় প্রকাশ করলো এই বলে,”এবারে অনলাইনে পড়াশোনা করাটাই বরাবরের জন্য চালু হয়ে যাবে মনে হচ্ছে! দেখি থার্ড ইয়ারটা হয়ে গেলেই বাঁচি। পরে যদি পড়াশোনা করতে হয় Distance- এ কোনো মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করবো।” উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জটিল সংকট ঘনিয়ে উঠেছে। চার দিকের খবর থেকে নিশ্চিত, সাম্প্রতিক শিক্ষাচিন্তার দুটো প্রধান দিক রয়েছে। এক, পড়াশোনা কী ভাবে চলবে? আর দুই, পরীক্ষা কী ভাবে সম্পন্ন হতে পারে? এই দু’দিকের সঙ্গেই যুক্ত সিদ্ধান্তগুলির একটি তাৎক্ষণিক, অন্যটি সুদূরপ্রসারী। ভাবনার কথা, সুদূরপ্রসারী দিকগুলি আপাত ভাবে কারও চোখে পড়ছে না। এই বিষয়ে ভাবনার এবং প্রশ্ন করার জায়গা থেকে যাচ্ছে।
      পরীক্ষা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যথাযথ পঠনপাঠন। শিক্ষার উদ্দেশ্য তো পরীক্ষা-দেওয়া আর পরীক্ষায় পাশ-করা নয়, পড়াশোনা-করা -এই পুরোনো দরকারি কথাটাকেই যেন ভুলতে বসেছি আমরা এই সংকটকালে। মোবাইল বা ল্যাপটপের এ-পারে একজন শিক্ষক কিছু কথা বললেন, পর্দার ওপারে কিছু ছাত্রছাত্রী তা শুনল, তা উচ্চশিক্ষার একটি সুন্দর সহায়ক ব্যবস্থা হতে পারে তবে বিকল্প ব্যবস্থা নয়। মনে রাখতে হবে, সারা দেশে, উন্নততম যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হলেও শিক্ষাব্যবস্থার একমাত্র পথ হতে পারে না। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক, একজন শিক্ষকের সঙ্গে প্রতিটি ছাত্রছাত্রীদের চোখের যোগাযোগটাও খুব দরকারি। কারণ, শিক্ষকতা তো শুধু শিক্ষাদান নয়, শিক্ষাগ্রহণও। নৈর্ব্যক্তিক ভাবে টানা পড়িয়ে-চলা নয়, শ্রোতা-ছাত্রছাত্রীমণ্ডলীর প্রত্যেকে কে কতটা গ্রহণ করতে পারছে, তার উপরেও নির্ভর করে পড়ানো। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর গ্রহণক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষককে প্রতি মুহূর্তে তাঁর বলাকে তৈরি বা সৃষ্টি করতে হয়। শিক্ষক-ছাত্রের এই মানবিক আন্তঃসম্পর্কটিও শিক্ষকতারই অঙ্গ।
      একে তো আমাদের রাজ্যে শিক্ষা ব্যবস্থার বেহাল দশা, তার ওপর আবার করোনা সংকটে অনলাইন শিক্ষা চালু হলে মানব সম্পদ শক্তিশালী হওয়া তো দূরের কথা বরং সেই সম্পদ দেশের আর তেমন কোনো কাজেই আসবে না হয়তো!
      এরই মধ্যে বহু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আর সেই ক্লাস চলছে বৈষম্যের চিরাচরিত রীতি মেনেই। অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে নাম না-জানা অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী । কীভাবে ? পশ্চিমবঙ্গের নিরীখে তা বোঝার চেষ্টা করা যাক-
      ১) গত তিনমাস যাবৎ লকডাউনের জন্য অসংখ্য দিন-আনা, দিন-খাওয়া মানুষের কাছে 4G নেট ব্যবহার আকাশের চাঁদ ধরতে চাওয়ার সমান।
      ২) ডিজিটাল ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপন যতই রংচঙে হোক না কেন, এখনও অধিকাংশ বাড়িতে স্মার্টফোন নেই। সংসারের টানাটানির চোটে সে ফোন ব্যবহার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বাতুলতা। সেটা শহরের বস্তি অঞ্চলের পরিবারগুলো থেকে শুরু করে গ্রামের পরিবারগুলিতে অনেকেরই অ্যানড্রয়েড ফোন ব্যবহার করার সামর্থ্য নেই। কোনো কোনো পরিবারে হয়তো খুব জোর একটা কী প্যাড ফোন থাকতে পারে। তা দিয়ে তো আর অনলাইন ক্লাস করা যায় না।
      ৩) ইন্টারনেট পরিষেবা, নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার ‘অতি-সক্রিয়তার’ (বেহাল দশা) কথা তো সকলেই জানেন।
      ৪) আমফান পরবর্তীতে যেখানে এখনো কয়েক হাজার মানুষের মাথায় ছাদ নেই। সেখানে অনলাইন ক্লাস করার কথা চিন্তা করা মানে হাসির খোরাক হওয়া। আর এর ফলাফল ? প্রতিদিন প্রতিনিয়ত মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের জেরে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে তারা, আর গিয়ে দাঁড়াচ্ছে অনিশ্চয়তার খাদের কিনারে। দেশের GDP ভেঙে পড়ার মতোই ভেঙে পড়ছে ভবিষ্যতের স্বপ্নের বাস্তবতা।
      যে সময় গোটা দেশ উত্তাল অভিনেতার মৃত্যু থেকে চিনা সামগ্রী বর্জনে, ঠিক তখনই অন্ধকার ভবিষ্যতের কাছে হার মেনে নেয় অনলাইন ক্লাস করতে না পারার অবসাদে। বালির শিবানী সাউ, কলকাতা থেকে অনতিদূরে মফঃস্বল এলাকার ক্লাস টেন – এর ছাত্রী। বাড়ির একমাত্র স্মার্টফোনটি নিয়ে বিহারে দেশের বাড়িতে গিয়ে লকডাউনে আটকে পড়েছিল বাবা-মা। দাদার সাথে থাকছিল ভাড়া বাড়িতে। সামনে মাধ্যমিক এর মধ্যে অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত , টানা চার মাস গৃহশিক্ষক থেকে বিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগের অভাবে পড়াশোনার ক্ষতির চিন্তা করে অবসাদের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছে শিবানী। শিক্ষা ব্যবস্থার চরম একমুখী বৈষম্যের শিকার সে। আরো হাজার হাজার অন্ধকারে থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিধি সে। যাদের কথা ভেবে শিক্ষানীতি গঠন হয়না, যাদের কথা ভেবে শিক্ষাব্যবস্থা টিঁকে থাকে না। এখন প্রশ্ন আসে শিবানী আত্মহত্যা করলো কার প্ররোচনায় ? চোখে আঙুল দিয়ে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দিতে হবে না সেটা। মুনাফাসর্বস্ব পৃথিবীর একটা মাধ্যম এখন শিক্ষা। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই একটা ব্যাবসায়িক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। শিক্ষা যেখানে মৌলিক অধিকার সেখানে , শিক্ষার সঠিক সুযোগ না পেয়ে আত্মঘাতী হয়েছে শিবানী। আসলে তো এটা আত্মহত্যা নয়, একটি প্রাতিষ্ঠানিক খুন! মৌলিক অধিকারের জন্য প্রয়োজন বৃহত্তর লড়াই। ছাত্র-ছাত্রী সমাজের স্বার্থে এই লড়াই সাধারণ মানুষকেই লড়তে হবে। ভবিষ্যতে আর কোনো শিবানী যাতে প্রতিষ্ঠানিক হত্যার শিকার না হয়, তার জন্যে নিরলস লড়াই জারি রাখতে হবে।