টালা আন্দোলন ..
২০১৯ সালের মহালয়ার সময়। টালা ব্রিজ ভাঙার নোটিশ জারী করলো সরকার। ব্রিজের দুই প্রান্ত ও মধ্যবর্তী অংশে সব মিলিয়ে শতাধিক পরিবারের বাস – সেই ব্রিজ তৈরির সময় থেকেই। টালা ব্রিজ মেরামত করার জন্য ভেঙে ফেলার নোটিশের সাথে সাথে এই পরিবারগুলোকেও দুই দিনের মধ্যে ঘর ছেড়ে যাওয়ার সরকারি নির্দেশ জারি করা হল। এতোগুলো পরিবারের এতো দিন ধরে বাস এখানে। এই ঠিকানায় তাদের অধিকাংশের বিদ্যুৎ, গ্যাসের সংযোগ, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড ইত্যাদি কাগজপত্র আছে। কোথায় যাবেন তারা এতোদিনকার এই ঘরবাড়ি ছেড়ে? মানুষ নিরুপায় হয়ে উপযুক্ত পুনর্বাসনের দাবীতে রাস্তায় নামলেন। রাস্তা অবরোধ করলেন তারা।
এই আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে এখানে গড়ে তোলা হল “বস্তিবাসী শ্রমজীবী অধিকার রক্ষা কমিটি – টালা”। সাময়িকভাবে মানুষগুলোর থাকার জায়গা, শৌচাগার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা করা গেল রাস্তার লড়াই ও আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে। উপযুক্ত পুনর্বাসনের দাবীতে এই লড়াইয়ের শুরুর দিন থেকেই পাশে ছিলেন বহু মানুষ। তাদের মধ্যে একজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রায়া দেবনাথ। রায়া একদম আন্দোলনের শুরুর দিন থেকেই সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এর সাথে। বারবার বলতেন ..
“এভাবে মানুষ থাকতে পারে নাকি? এ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না!”
কোন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর পড়ার বইয়ের প্রয়োজন, পড়াশোনার জন্য আলোর প্রয়োজন তার খেয়াল রাখা থেকে শুরু করে সবচেয়ে বয়স্কা মানুষটির নিয়মিত খোঁজখবর রাখা, সবই ছিল রায়ার আদর-ভালোবাসার ঝুলির মধ্যে। খালপাড় আর নীচু নর্দমার ধারে কালো প্লাস্টিকের ঘরগুলোয় মশার উৎপাত। রায়ার উদ্যোগে সব কটা পরিবারের জন্য মশারির ব্যবস্থা করলো রায়ার বন্ধুরা। এভাবেই রায়া জড়িয়ে
গেছিলেন এখানকার আন্দোলনের সাথে, এখানকার প্রতিটা মানুষের জীবনযন্ত্রণা, আশা-আকাঙ্খার সাথে। আমাদের “সংহতি ইস্কুল” নামকরণ তখনো হয়নি। কিন্তু রায়ার স্বপ্ন ছিল এরকম একটা শেখা-শেখানোর পরিসর টালায় হোক। আলোচনায় বহুবার সেরকম ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল ও। রায়া আজ আমাদের মধ্যে নেই – অকস্মাৎ অসুস্থতা তাকে কেড়ে নিয়েছে আমাদের থেকে।
রায়ার স্বপ্নকে সাথী করেই পথ চলা শুরু হয়েছে “রায়ার পাঠশালা”র – গত ১১ই অক্টোবর, ২০২০ থেকে।
রায়ার বন্ধুরা, রায়া দেবনাথ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট আমাদের এ যাত্রার সাথী। “রায়ার পাঠশালা” এগিয়ে নিয়ে চলেছে টালার রাহুল, সুচরিতা, পুর্নেন্দু সহ আরো অনেকে। পরিচালনা করার ব্যাপারে পাশে আছে বিশ্বজিৎ (মামা), শালিনী, স্নেহময় এরকম আরো নানা জন। মূলত ক্লাস এইট অব্দি বাচ্চাদের
নিয়মিত ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাসের পাঠ ও নাচ, গান, গল্প শোনা/বলার আসর এরকম নানাকিছু উপাদান এখানকার শেখা-শেখানোর বিষয়ভুক্ত। সপ্তাহে রবিবার ছুটি। বাকি প্রতিদিনই চলে এই পাঠশালা। ঠিক টালা ব্রিজের পাশে এই পাঠশালার পাশাপাশি একটু দূরে কলকাতা স্টেশনের কাছেও শুরু হয়েছে রায়ার পাঠশালার আরেকটি ভাগ। সেখানে মূলত হিন্দী মাধ্যমে পড়াশোনার বন্দোবস্ত। খুদেদের ক্লাসের পাশাপাশি বড়োদের শেখা-শেখানোর পরিসর হিসাবেও বেড়ে উঠছে রায়ার পাঠশালা।